
ওয়াকার মুস্তাফা, সাংবাদিক ও গবেষক
রমজান বায়রাম কিংবা সেকার বায়রাম, অটোমান সাম্রাজ্যে এই নামেই ডাকা হতো ঈদকে। তুর্কি ‘বায়রাম’ শব্দের অর্থ উৎসব আর ‘সেকার’ শব্দের অর্থ মিষ্টি।
ছয়শো বছর ধরে রাজত্ব করা সুবিশাল অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকেরা ছিলেন ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ইসলামের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর তাই রাজকীয় সমারোহে উদযাপিত হতো এই সাম্রাজ্যে।
বিদেশি ভাষায় বা ইংরেজিতে অটোমান সাম্রাজ্য বলে বর্ণনা করা হলেও, তুরস্কের ভাষায় তার নাম ওসমানী সাম্রাজ্য।
সেই সাম্রাজ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বায়রাম’ উদযাপনের শুরুটা হয়ে যেতো চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে।
ঈদের চাঁদ দেখা গেলে দুটি ভিন্ন স্থান থেকে তিনবার করে তোপধ্বনির মাধ্যমে জানান দেওয়া হতো।
তোপ দাগানোর রেয়াজ ছিল ঈদের সকালেও। নামাজের পর ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন স্থান বিশেষ করে প্রাসাদসমূহের ফটক এবং অন্যান্য শহরে তোপধ্বনি করা হতো।
চাঁদরাতে মশাল দিয়ে আলোকিত করা হতো তোপকাপি প্রাসাদ।
আরো পড়তে পারেন:
ছয়শো বছরের অটোমান সাম্রাজ্যের শুরু ও শেষ যেভাবে ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
অটোমান সাম্রাজ্য: বংশের ধারা ধরে রাখতে উপপত্নীরা যে ভূমিকা রেখেছেন১৭ জুলাই ২০২৩
“ঈদের দিনে হুররাম সুলতানের মাথায় শোভা পেতো পান্না ও রুবি খচিত সোনার মুকুট। নিজের সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি পরতেন তিনি।”
ইতিহাসবিদ জন ফারলি অটোমান সম্রাট সুলতান সুলেমানের স্ত্রী হুররামের ঈদের সাজের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেই।
হুররাম সুলতান সূক্ষ্ম কাজ করা পোশাক এবং গয়না পছন্দ করতেন বলে জানাচ্ছেন মি. ফারলি।
ইতিহাসবিদ লেসলি প্যারিসের মতে, অটোমান সুলতানদের স্ত্রীরা দরিদ্রদের মধ্যে খাবার ও পোশাক বিতরণ করতেন।
আর, ঈদের দিন সুলতান কী করতেন?
সুলতান সকাল সকাল তার লোকবহর নিয়ে মিছিল বা শোভাযাত্রা করে মসজিদের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তেন।
হায়া সোফিয়া কিংবা নীল মসজিদে যেতেন নামাজ পড়তে।
প্রাসাদের ফটক থেকে শুরু হওয়া সেই মিছিল দেখতে পথের দু’ধারে সমবেত হতো ইস্তাম্বুলবাসী।
প্রহরীদের সতর্ক উপস্থিতি থাকতো শোভাযাত্রা ঘিরে।
নামাজ শেষ করে বহর নিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসতেন সম্রাট।
ছবির উৎস,Getty Images
প্রাসাদে পৌঁছে সিংহাসনে বসতেন সুলতান। শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন রাজপুত্র, রাজকর্মচারী ও হারেমের বাসিন্দাদের সাথে।
আগতদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। সোনা ও রূপার পাত্রে ঈদের বিশেষ মিষ্টান্ন পরিবেশন করা হতো তাদের।
আহার শেষে, সুলতান সমুদ্রতীরের প্রাসাদে যেতেন। সেখানে নানান বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতো।
কুস্তি, বন্দুক ও বর্শা দিয়ে লক্ষ্যভেদ ও তীর-ধনুকের খেলা দেখাতেন দক্ষ ব্যক্তিরা।
ঈদ উপলক্ষে কখনো কখনো বড় বড় ভোজের আয়োজন করতেন অটোমান শাসকরা।
শহরের বিশেষ বিশেষ স্থানে প্যাভিলিয়ন(তাবু) করা হতো। সুলতান এবং বড় বড় কর্মকর্তাদের বসার ব্যবস্থা থাকতো সেখানে।
সুসজ্জিত করা হতো পথঘাট। ছোট-বড় সবার জন্য দোলনার ব্যবস্থা থাকতো।
খাবার, শোভাযাত্রা, নানান শারীরিক কসরত প্রদর্শন থেকে শুরু করে বই বাঁধাইয়ের মতো আয়োজনের পসরা দেখা যেতো।
জায়গাটা জাল দিয়ে ঘেরা থাকতো বলে প্রাসাদ থেকে নারীরাও সেখানকার আয়োজন দেখতে পেতেন।
শোভাযাত্রা শেষে সুলতানের তরফ থেকে ঈদ উপহার দেয়া হতো সবাইকে।
সুলতান সুলেমানের রাজত্বকালে ঈদ উদযাপনের বর্ণনা দিয়ে অটোমান ইতিহাসবিদ মুস্তাফা আলী বলেন, “সুলতান তার কর্মকর্তা ও প্রজাদের কাছ থেকে অভিনন্দন গ্রহণ করতেন এবং দরিদ্রদের মধ্যে উপহার বিতরণ করতেন।”
ছবির উৎস,Getty Images
হুররাম সুলতান ও সুলতান সুলেমানের তৈলচিত্র
অতঃপর সুলতান হারেমের নারীদের সাথে দেখা করতে যেতেন। তাদের সাথে কিছুটা সময় কাটাতেন তিনি।
বাকলাভা (এক ধরনের মিষ্টি) থাকতো তাদের আতিথেয়তায়।
দারুচিনির স্বাদের বাকলাভা নারীদের জন্য, পুরুষদের জন্য এলাচের স্বাদে বানানো বাকলাভা পরিবেশন করা হতো। আর, লবঙ্গের বাকলাভা থাকতো উভয়ের জন্য।
সাধারণ পরিবারেও ঈদ উপলক্ষ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যেত।
শিশুদের নতুন পোশাক কিনে দিতেন বাবা-মায়েরা। সেগুলো পরে পথে বেরুতো তারা।
নারীরা সবচেয়ে ভালো গয়নাগুলো পরতেন, সঙ্গে সুদৃশ্য পোশাক। হাতে মেহেদি ব্যবহারের চল ছিল।
ইতিহাসবিদ আহমেদ বিন মুস্তফার মতে, নারী জটিল নকশায় মেহেদি লাগাতেন যা শেষ করতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগত।
পারিবারিক পরিমণ্ডলে শুভেচ্ছা জানানোর সময়, তরুণরা পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের ডান হাতে চুম্বন করতো। বিনিময়ে তরুণদের মিষ্টিমুখ করানো হতো।
জোহরের নামাজের পর কবরস্থানে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রার্থনার রীতি তখনো ছিল।
ছবির উৎস,Getty Images
ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদ।
ঈদের তিন দিন নৌবাহিনী উপকূলে উৎসব করতো।
শহরে ২৪ঘন্টাই বিনোদন ও ক্রীড়ার অনুমতি দিতেন সুলতান।
আনন্দমুখর সময় কাটাতে দুই বা তিন আকচে (মুদ্রা) ছিল যথেষ্ট।
নগরজুড়ে উৎসবের আয়োজন দেখতে বিদেশিরাও আসতেন ইস্তাম্বুলে।
শেষ অটোমান খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের রাজত্বকালে, নাট্য পরিবেশনাও ঈদ উৎসবের অংশ হয়ে ওঠে।
ইস্তাম্বুলে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরাও আমন্ত্রণ পেতেন নাটক দেখার।
এমন নানান আয়োজনে জাকজমকপূর্ণভাবে অটোমানদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম রমজান বায়রাম তথা ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করে এসেছে।
১৩ শতকে ওসমান গাজীর হাত ধরে এই সাম্রাজ্যে যাত্রা শুরু হয়েছিল।
ছয় শতাব্দী পার করে সাম্রাজ্যের পতন হয় একশো বছর আগে ১৯২৪ সালে।
নির্বাসনে পাঠানো হয় দ্বিতীয় আব্দুল হামিদকে। বিবিসি