
গৃহযুদ্ধের মধ্যে থাকা মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য শর্তসাপেক্ষে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে বলে সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকার কিসের ভিত্তিতে এবং কোন প্রক্রিয়ায় ‘মানবিক করিডর’ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারের উচিত ছিল, দায়িত্ব ছিল এই বিষয়টা নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলা।
এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিএনপির মহাসচিব।
বিষয়টি নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারাও সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেছেন।
এদিকে, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যে ‘হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজে’র বিষয়ে নীতিগত সম্মতির কথা উল্লেখ করা হলেও বিষয়টি নিয়ে এখন ভিন্ন ব্যাখ্যা তুলে ধরছে সরকার।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আমরা এটা স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে সরকার তথাকথিত ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেনি। রাখাইন রাজ্যে যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সাহায্য দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে রাজি হবে, এটাই আমাদের অবস্থান।
রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর ব্যাপারে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলেও জানানো হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোসহ সবপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।
তবে সরকার যদি ত্রাণ পাঠাতে ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’ দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে সহায়তাটি কেবলমাত্র বাংলাদেশের ভূখণ্ডে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান বলেছেন, আমরা মিয়ানমারের মাটিতে ঢুকব না। যতটুক সহায়তা দেওয়ার বাংলাদেশের ভেতরেই দেওয়া হবে।
এছাড়া দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
কোন দল কী বলছে?
রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাংলাদেশের সক্রিয় সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনা করা উচিত ছিল বলে মনে করে বিএনপি।
সোমবার ঠাকুরগাঁওয়ে এক সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটা অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা জড়িত।
তিনি আরও বলেন, মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে এটা হতে হবে সব মানুষের সমর্থনে।
কিন্তু সেটা না করে সরকার ‘এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে’ ওই করিডর দিতে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।
এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিএনপি মহাসচিব।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা আরেকটা গাজায় পরিণত হতে চাই না। আমরা আরেকটি যুদ্ধের মধ্যে জড়াতে চাই না। আমাদের এখানে এসে আরও কেউ গোলমাল করুক, সেটিও আমরা চাই না।
এদিকে, ‘মানবিক করিডরে’র বিষয়ে সরকারের কাছে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দাবি করেছে জামায়াতে ইসলামী।
সোমবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের পোস্টে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান লেখেন, রাখাইনের সঙ্গে মানবিক করিডরের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এ বিষয়টি জাতির সামনে স্পষ্ট করা দরকার। কারণ এর সঙ্গে অনেক নিরাপত্তার বিষয় জড়িত থাকতে পারে।
একই বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ নিজের ফেরিভায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তামূলক নীতি গ্রহণে অবশ্যই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।
তিনি আরও লেখেন, আলোচনা ব্যতীত এ ধরনের সিদ্ধান্তে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ইনটেগ্রিটি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
এনসিপি’র আরও বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, করিডর ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মামুনুল হক বলেন, বাংলাদেশকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে, দেশপ্রেমিক শক্তি হিসেবে হেফাজতে ইসলাম কোনোভাবেই এটি সমর্থন করে না। এর নিন্দা জানাই। আমরা এর প্রতিবাদ জানাব।
সরকার যা বলছে
বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে গত রোববার নিজ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডর) হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।
এরপর বিষয়টি নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনার পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, মানবিক করিডর নয়, বরং রাখাইনে জাতিসংঘ সহায়তা দিতে চাইলে সেটা পৌঁছাতে পরিবহনসহ লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগত সম্মতি দিয়েছে।
মঙ্গলবার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে এক চরম মানবিক সংকট চলছে বলে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) জানাচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে রাখাইনের ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর ‘একমাত্র কার্যকর পথ’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নীতিগতভাবে জাতিসংঘকে ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’ প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এছাড়া আমরা উদ্বিগ্ন যে দুর্ভোগ অব্যাহত থাকলে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে মানুষের প্রবেশ আরও বেড়ে যেতে পারে, যেটা আমরা বহন করতে পারছি না।’
তবে সাহায্য প্রদানের বিষয়ে এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।
শফিকুল আলম লিখেছেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে আমরা এ বিষয়ে যোগাযোগে রয়েছি। যথাসময়ে আমরা বাংলাদেশের স্টেকহোল্ডারদের সাথে পরামর্শ করব।
এ বিষয়ে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জানান, সরকারের কাছ থেকে আলোচনার ডাক পেলে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দলের অবস্থান তুলে ধরবেন।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, তার আগে সরকারকে আমাদের বোঝাতে হবে যে, কোন কোন শর্তে এটা দেওয়া হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের কী লাভ হবে? এরপর দলীয় ফোরামে আলাপ-আলোচনা করে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নেব।
আলোচনাটি যেভাবে এলো
আরাকান বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত বছর ১৪ ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শিরোনামের একটি আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি দেওয়া বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি– সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগের একটি ধারণা দিয়েছিলেন।
ওই আলোচনা সভাতেই সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমান মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য ব্যবসা–বাণিজ্য করা ও মানবিক করিডর খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এরপর মার্চের শুরুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাখাইনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মির মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে মন্তব্য করে।
এর কয়েকদিন পরেই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ঢাকায় আসেন ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তখন রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য একটি করিডর চালু করতে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ।
৮ এপ্রিল ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে খলিলুর রহমান মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প না থাকার কথা তলে ধরেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র চ্যানেল, যার মাধ্যমে এটা করা সম্ভব। কারণ, রাখাইনের উপকূল এখনও তাতমাদোর (জান্তা বাহিনী) দখলে এবং অন্যান্য জায়গা দিয়ে সহজে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব নয়।
তিনি তখন জানিয়েছিলেন যে, মানবিক চ্যানেল (প্রস্তাবিত করিডর) তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মিকে জাতিসংঘই আলোচনায় বসাচ্ছে আর আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করছে বাংলাদেশ।
এক্ষেত্রে আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনায় জাতিসংঘকে মাঝামাঝি রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে, গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেলে’ বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রথম এসেছিল।
খলিলুর রহমান বলেছিলেন, আরাকান আর্মি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিয়ানমার সরকার- সবার সঙ্গে আলোচনা করেই তখন জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে গিয়েছিলেন।
পরদিন ৯ এপ্রিল খলিলুর রহমানকে একইসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদেও নিয়োগ দিয়ে সরকার জানায়, এখন থেকে তার পদবি হবে ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ’।
এরপর রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানালেন যে, সরকার হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বা করিডরের প্রস্তাবে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, প্রভাবশালী পশ্চিমা কয়েকটি দেশ দীর্ঘকাল ধরেই বাংলাদেশের কাছে এমন একটি করিডরের পরামর্শ বা প্রস্তাব দিয়ে আসলেও রাজনৈতিক সরকারগুলো ভূ-রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় তাতে কখনো সায় দেয়নি। সূত্র: বিবিসি বাংলা