আমিনুল ইসলাম মল্লিক
সারাদেশে বর্তমানে লাখের বেশি মামলার জট লেগে আছে। এর একটি বড় অংশই দেওয়ানি। পারিবারিক বিরোধ ও জমিজমাসংক্রান্ত এসব মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কথা ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। অনেকে বলে থাকেন, একটি দেওয়ানি মামলা বাবা দায়ের করলে ছেলে, এমনকি নাতিকেও সেই মামলার ঘানি টানতে হয়। জমি-জিরাত বিক্রি করে বছরের পর বছর, এমনকি যুগের ইতি ঘটলেও প্রতিকার মিলে না বিচারপ্রার্থীর। এ যেন এক মামলা মেটাতে তিন প্রজন্মের পাহাড় টানার মতো অবস্থা।
তবে বিচারপ্রার্থীদের এই জটিলতা থেকে মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দেশে দেওয়ানি মামলা দ্রুত সুরাহা হবে এবং মামলার জটও কমে আসবে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
হয়রানিমূলক মামলায় জরিমানা বৃদ্ধি, নির্দিষ্ট সময়ে বিচার সম্পন্ন করা এবং ডিজিটাল যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ রেখে সিভিল প্রসিডিউর কোড বা দেওয়ানি কার্যবিধিতে সংস্কার আনছে সরকার। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) ঢাকার তেজগাঁওয়ে নিজ কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
‘এতে করে মামলা জট কমবে, বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার পাবে। সরকারের ভালো কাজগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।’
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন দেওয়ানি কার্যবিধি বা সিভিল প্রসিডিউর কোডে (সিপিসি) কিছু কিছু পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছিল। তারই আলোকে ব্রিটিশ সরকারের সময়ে প্রণীত সিপিসিতে কিছু পরিবর্তন আনার জন্য নীতিগত অনুমোদন হয়েছে।
উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশে একটি কথা আছে, কারও সঙ্গে শত্রুতা করলে ভূমির মামলা দিয়ে দাও। তাহলে তিন প্রজন্মেও সেই মামলা আর শেষ হবে না। তাই সেই তিন প্রজন্ম যেন না লাগে, এক প্রজন্মেই যেন শেষ করা যায়, সে জন্য সিপিসির কিছু সংশোধনী আনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যাতে করে বিচারের সময় কম লাগে, টাকা কম লাগে।
কী কী পরিবর্তন আনা হচ্ছে
আগে একটা মামলার রায় হয়ে যাওয়ার পর জারি মামলা করতে হতো সেই রায় কার্যকরের জন্য। এখন থেকে রায়ের মধ্যেই বাস্তবায়নের বিষয়টি যুক্ত করে দেওয়া হবে।
আরো পড়ুন
মামলা জটে বিপর্যস্ত বিচার বিভাগ, নথি সংরক্ষণে হিমশিম
বিভিন্ন সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। সংশোধিত দেওয়ানি কার্যবিধিতে বলে দেওয়া হয়েছে, সর্বোচ্চ কতবার সময় নেওয়া যাবে।
তালিকায় পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্য কয়টা মামলা নেওয়া যাবে এবং আংশিক শুনানির জন্য কয়টা মামলা নেওয়া যাবে সেটাও ঠিক করে দেওয়া হবে।
বিচারপ্রক্রিয়া অনেকাংশেই পুরনো পদ্ধতিতে রয়ে গেছে। আগের মতো আর সমন জারি হবে না। টেলিফোন, এসএমএস বা অন্যান্য আধুনিক যোগাযোগ পদ্ধতি অবলম্বন করে সমন জারি করা হবে।
কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য ভুয়া মামলা করার সুযোগ কমে যাবে। আগে ভুয়া মামলার শাস্তি ছিল ২০ হাজার টাকা, এখন সেটা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
কী বলছেন আইনজ্ঞরা
সরকারের এই উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, দেওয়ানি মামলার প্রক্রিয়াগুলো অনেক কঠিন। তবে কঠিন বিষয়টি সে সময়ের জন্য সঠিক ছিল। এখন আর আগের পরিবেশ নেই।
এই আইনজীবী বলেন, আগের মানুষের চরিত্র একরকম ছিল, এখন অন্যরকম। সেসময় মামলার সংখ্যা কম ছিল। এখন সেটি বহুগুণে বেড়েছে। এখন আদালতের পরিবেশও ভিন্ন। সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুই। এজন্য সরকারের এমন সিদ্ধান্ত যথোপযুক্ত।
মনজিল মোরশেদ বলেন, এতে করে মামলা জট কমবে, বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার পাবে। সরকারের ভালো কাজগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
সরকারের এমন সিদ্ধান্ত যুগোপযোগী উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি এবং সিনিয়র আইনজীবী এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন থেকে দেওয়ানি মামলার ভার আর তিন প্রজন্মকে টানতে হবে না। দেওয়ানি আইন সংশোধনের বিষয়ে সরকার ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। আমি মনে করি আরও সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। আগে যেমন একটি দেওয়ানি মামলা করতে অনেক সময় লেগে যেত, বিচারপ্রার্থী ভোগান্তির শিকার হতো, সেই ভোগান্তি থেকে এখন মুক্তি মিলবে।