০৭:৩২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

পহেলা বৈশাখ সংখ্যা

  • আপডেট সময়: ০৬:০৫:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
  • 23

 উত্তরাধুনিক ডেস্ক: বাংলার বৈশাখের দু’টি দিক আছে–প্রাকৃতিক আর উৎসবীয় দিক। সাধারণত বৈশাখ বলতে আমাদের সংস্কার ও মানসে উৎসবীয় আমেজটাই আগে এসে যায় প্রথমে। আমরা ঋতু পালাবদলের দিকটা তেমনভাবে অনুভব করি না, বিশেষত শহরাঞ্চলে দালানকোঠা ও ব্যস্ত জীবনের আড়ালে বৈশাখের প্রাকৃতিক রূপ ও সৌন্দর্য অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়। তবে উৎসবের আমেজে, কুশল বিনিময়ে, মেলায়, পান্তা ও শহুরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শহর গমগম করে। শহরে বসে কি আর বৈশাখের পরিপূর্ণ আবহ মেলে? বৈশাখ, তথা যেকোনো ঋতু পরিবর্তনের আমেজ পেতে গ্রামে যেতে হবে। বসে থাকতে হবে আম-কাঁঠাল গাছের ছায়ায়। দেখতে হবে ইশান কোণে হঠাৎ জেগে ওঠা কালো ছায়া। রাতে শুয়ে ঝি ঝি পোকার তান শুনতে হবে। নাকে লাগাতে হবে পাকা আম-কাঁঠালের ঘ্রাণ। নিস্তব্ধ নিরালা দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনতে হবে। যেতে হবে গ্রামীণ মেলায়।

বৈশাখ এলে মনে অনুরণন তোলে কবিগুরুর সেই চিরায়ত সঙ্গীতটি:
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো…।’

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক পার্বণের বিচিত্র সমারোহে জড়িয়ে থাকা প্রকৃতির এক লীলাময় পর্ব। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া বৃক্ষের শাখায় শাখায় লাল-হলুদ ফুলের রঙিন উচ্ছ্বাস যেন বর্ণিল ট্যাপেস্ট্রি। বৈশাখের ভোরের হাওয়া মনের চিরন্তন রূপের বর্ণালী ছড়াতে আরেক দিনের প্রভাত নতুনের বাণী শুনিয়ে হৃদয়ে স্পন্দন তোলে। স্তব্ধ দুপুরের কাঠফাটা রোদেলা প্রকৃতি মনে বিচিত্র দোলা দিয়ে যায়।

পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের সার্বজনীন উৎসব। দেশে এবং সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীতের দুঃখ-গ্লানি।

উত্তরাধুনিক পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।

♣♣♣

এসো হে বৈশাখ

হাসান জাহিদ

বছর ঘুরে বাঙালির জীবনে এলো আরও একটি বৈশাখ। বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি  বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়।

বৈশাখে এলে মনে অনুরণন তোলে কবিগুরুর সেই চিরায়ত সঙ্গীতটি:

‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো…

যাক পুরাতন স্মৃতি
যাক ভুলে যাওয়া গীতি
যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
যাক যাক
এসো এসো…।’

আর নব্বই দশকের শেষার্ধ থেকে এখনও পর্যন্ত ‘মেলাই যাইরে’ গানটি জনপ্রিয়। ফিডব্যাকের ‘মেলায় যাইরে’ গানটির লিরিকের কিছু অংশ:

‘মেলায় যাইরে. লেগেছে বাঙালীর ঘরে ঘরে একি মাতনদোলা

লেগেছে সুরেরই তালে তালে হৃদয় মাতনদোলা.

বছর ঘুরে এল আরেক প্রভাতী ফিরে এলো সুরেরই মঞ্জুরী

পলাশ শিমুল গাছে লেগেছে আগুন

এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি মেলায় যাইরে।’

বাংলার বৈশাখের দু’টি দিক আছে–প্রাকৃতিক আর উৎসবীয় দিক। সাধারণত বৈশাখ বলতে আমাদের সংস্কার ও মানসে উৎসবীয় আমেজটাই আগে এসে যায় প্রথমে। আমরা ঋতু পালাবদলের দিকটা তেমনভাবে অনুভব করিনা, বিশেষত শহরাঞ্চলে দালানকোঠা ও ব্যস্ত জীবনের আড়ালে বৈশাখের প্রাকৃতিক রূপ ও সৌন্দর্য অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়।

অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল  হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। হালখাতা অনুষ্ঠান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে এখনও হয়, তবে সীমিত সংখ্যায়।

অতীতে গবাদি পশুকে স্নান করানো, অতিথি বরণ প্রভৃতি প্রথা ছিল খুবই সুপরিচিত প্রথা।

 বউমেলা

ঈশা খাঁর সোনারগাঁয় ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম ‘বউমেলা’। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পয়লা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজোর জন্য এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা। পাঁঠাবলির রেওয়াজও পুরনো। বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে। বউমেলায় কাঙ্ক্ষিত মানুষের খোঁজে কাঙ্ক্ষিত মানসীর প্রার্থনা কিংবা গান্ধর্ব প্রণয়ও যে ঘটে না সবার অলক্ষে, তা কে বলতে পারবে।

 ঘোড়ামেলা

এ ছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ঘোড়ামেলা। লোকমুখে প্রচলিত যামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ওই স্থানেই তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে প্রচলিত মেলাটির নাম ঘোড়ামেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। সকাল থেকেই এ স্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। এক দিনের এ মেলাটি জমে ওঠে দুপুরের পর থেকে। হাজারো লোকের সমাগম ঘটে। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারণে এ মেলার আয়োজন করা হয়। তথাপি সব ধর্মের লোকজনেরই প্রাধান্য থাকে এ মেলায়। এ মেলায় শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি থাকে। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নানারকম আনন্দ-উৎসব করে পশ্চিমের আকাশ যখন রক্তিম আলোয় সজ্জিত উৎসবে, যখন লোকজন অনেকটাই ক্লান্ত, তখনই এ মেলার ক্লান্তি দূর করার জন্য নতুন মাত্রায় যোগ হয় কীর্তন। এ কীর্তন হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এভাবেই শেষ হয় বৈশাখের এই ঐতিহ্যবাহী মেলা।

কোলকাতা

ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কোলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম ‘চৈত্র সেল’। তাই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবং এই ছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করতে অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে কলকাতার সমস্ত মানুষ একমাস ধরে নতুন জামাকাপড়, ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে।

বাংলা ১৪৩২ সনের পহেলা বৈশাখ বয়ে আনুক সবার মাঝে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।

♣♣♣

প্রাণের বৈশাখ

আতোয়ার রহমান

বাঙালির জীবনে উৎসবের রং ছড়িয়ে বছর ঘুরে আবার এল পয়লা বৈশাখ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুনামগাঞ্জ থেকে চুরুলিয়া, টোকিও থেকে টরন্টো পর্যন্ত আজ ভাসবে বিপুল আনন্দের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। সবাই যোগ দেবেন বাংলাদেশের জনগনের সবচেয়ে বড় সার্বজনীন উৎসব বৈশাখী উৎসবে। বাঙালির কন্ঠে আজ ছড়িয়ে যাবে বাংলা নতুন বছরকে সম্ভাষণ  জানিয়ে রচিত রবি ঠাকুরের সঙ্গীতের সেই চেনা সুর ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…। ‘

বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন আজও ধর্ম ও সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সব শ্রেণীর বাঙালির জাতীয় উৎসব। পয়লা বৈশাখ ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের দিন হিসেবে একেবারেই আমাদের মাটি আর মানুষ থেকে উৎসারিত। এটি আমাদের আপন সাংস্কৃতিক চেতনা ও ঐতিহ্যের স্মারক, আপন জাতিসত্তায় অনুপ্রাণিত  হওয়ার উৎস, জাতীয় ঐক্যবোধে দীপ্ত হওয়ার উপলক্ষ, জাতির প্রতিচ্ছ্ববি। বাঙালির বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের প্রতিক পয়লা বৈশাখ। দিন দিন এই উৎসব উদযাপনের ব্যাপকতা বৃদ্বি পাচ্ছে।

মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়কে ঘিরে বাদশাহ আকবরের সময় এর প্রচলন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বানিজ্যের হালখাতার বিষয়টি। যদিও আজকাল হালখাতায় বাকিবকেয়া পরিশোধের প্রবণতা কমে গেছে। পয়লা বৈশাখের উৎসব শুরুর দিকে ছিল গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক; এখন শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জ–সারা দেশে চলে প্রাণের জোয়ার। চারিদিকে নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস। পথে পথে উৎসব প্রিয় বাঙালির ঢল। মাটির হাঁড়ি, আলপনা, নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ঢোলের বাদ্য, আর বাঁশির সুর।

তরুণেরাই এখন এ উৎসবের প্রাণ। তরুণেরা এখন বিভিন্নভাবে এ উৎসবকে পুনরাবিস্কার করছেন। চৈত্র শেষ হতে না হতেই সব তরুণের মনে উৎসবের রঙ জমে। তাঁরাই উৎসবের রঙ ছড়ায় সবখানে, গান বাজায় প্রাণে প্রাণে।  এ উৎসবের ভিত্তিটা  গড়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষক সমাজ। তরুণ-তরুণীরা বৈশাখী উৎসবের রঙিন পোশাক পরে বেরিয়ে আসে। তরুনীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, কাচের চুড়ি, ফুলের মালায় সাজবে, তরুণদের পরনে থাকবে রঙিন পাঞ্জাবি, ফতুয়া, পায়জামা।

এধরণের একটি শেকড়ধর্মী উৎসব  সংস্কৃতির ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয়ে  সহায়তা করে তারুণ্যকে নানা ধান্দাবাজি ও অপরাজনীতির কবলে পড়ে বিভ্রান্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করবে। এ উৎসব আমাদের আপন সংস্কৃতি লালন ও নিজেদের মধ্যে তা বিকশিত করার নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করবে, বিদেশি অপসংস্কৃতি থেকে দূরে রাখবে আমরা এই প্রত্যাশা করি। তবে কর্পোরেট বানিজ্যের আগ্রাসি থাবা থেকে এ উৎসবের মূল সুরকে রক্ষা করার ব্যাপারে আমাদের সকলকে সজাগ থাকতে হবে। মিডিয়ার সাহায্যে কোম্পানিগুলো আমাদের প্রাণের এই উৎসবকে যেনো বিপণনযোগ্য আইটেমে পরিণত করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমাদের সকলকে সচেতন থাকতে হবে।

শুধু দেশে নয়, বিদেশে বসবাসকারি বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাঙালির মধ্যেও  বৈশাখ নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই।  পহেলা বৈশাখ নিয়ে দেশের মধ্যে যে উদ্দীপনা, তার চেয়ে  বিশ্বের সর্বত্র মাকড়সার জালের মত ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের মোটেও কম নয়।  শুধু প্রথম প্রজন্ম নয়, ভিন্ন ভাষা আর সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা প্রবাসের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও বেশ আন্তরিকতা ও মমতার সাথে এসব উৎসব অনুষ্ঠান ও অংশগ্রহন করে থাকে। প্রবাসে  জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা বাঙালি প্রজন্মকে জাতির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও এর ইতিহাসের সঙ্গে  পরিচয় করিয়ে দেয় এ উৎসব। এখানে কানাডাতেও বৈশাখী মেলা ৫-৬ দিনব্যাপী হয়। অনেক ধরণের মেলা হয়, পিঠা উৎসব হয়, ঢাকার চারুকলার আদলে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। সামাজিক সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আয়োজনে মনোজ্ঞ  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলার  আয়োজন করা হয়,  মেলা ও অনুষ্ঠানস্থল  একেবারে লোকারণ্য হয়ে যায়। যদিও প্রবাসে কালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়া বহে না, কালোমেঘ ধেয়ে এসে কোন ধুলিঝড়ের সৃষ্টি করেনা তবুও বাঙালিরা  উৎসবে মেতে ওঠার ক্ষেত্রে কোনক্রমেই পিছিয়ে থাকেনা। এর মধ্যে তারা খুঁজে পায় তাদের শৈশবে দেখা নদীর ধারের  গ্রাম্য মেলার স্মৃতি, তাদের হারানো শিকড়, হারানো ঐতিহ্য, ফেলে আসা দেশ।

ঐতিহ্যবাহী দেশি খাবারের উৎসব চলে। খাবার দাবারেও  প্রাধান্য পাবে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পছন্দের খাবারগুলো। পান্তা, ইলিশ, বিভিন্ন রকমের ভর্তা, ভাজি, আচার, চাটনি, চটপটি, খই-মুড়ি-মুড়কি, জিলাপি, খোরমা, বাতাসা-মন্ডা-বুন্দিয়া, আরো কত কী! বছরের প্রথম দিনটি উদর পূর্তি কোঁরে কাটিয়ে দিবে উৎসবে গা ভাসানো আপামর বাঙালি।

সাধারণ মানুষের আশা নতুন বছরে নতুন সুখ-সমৃদ্বির শুরু হবে, জীবনযাপনের মান আরও উন্নত হবে, অশুভের দমন করা হবে। নতুন বছরটি সবার ভালভাবে কাটবে। সকলের জীবনে শান্তি আসবে, সমাজ ও রাজনীতি সুস্থ হবে, দূষণমুক্ত হবে। তাদের যাপিতজীবনে অনন্ত আনন্দধারা বয়ে যাক। সমস্ত বিভেদ ও অনৈক্য ভুলে গিয়ে আমরা যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি বিশ্বসভায়। একটি সুখি ও শান্তিপূর্ণ সমাজের আশায় সকলকে আবারও নববর্ষের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।

♣♣♣

আমাদের বৈশাখ

দিলারা শাহীন শোভা

ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে

বাংলার বৈশাখের দু’টি দিক আছে–প্রাকৃতিক আর উৎসবীয় দিক। সাধারণত বৈশাখ বলতে আমাদের সংস্কার ও মানসে উৎসবীয় আমেজটাই আগে এসে যায় প্রথমে। আমরা ঋতু পালাবদলের দিকটা তেমনভাবে অনুভব করি না, বিশেষত শহরাঞ্চলে দালানকোঠা ও ব্যস্ত জীবনের আড়ালে বৈশাখের প্রাকৃতিক রূপ ও সৌন্দর্য অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়। তবে উৎসবের আমেজে, কুশল বিনিময়ে, মেলায়, পান্তা ও শহুরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শহর গমগম করে। শহরে বসে কি আর বৈশাখের পরিপূর্ণ আবহ মেলে? বৈশাখ, তথা যেকোনো ঋতু পরিবর্তনের আমেজ পেতে গ্রামে যেতে হবে। বসে থাকতে হবে আম-কাঁঠাল গাছের ছায়ায়। দেখতে হবে ইশান কোণে হঠাৎ জেগে ওঠা কালো ছায়া। রাতে শুয়ে ঝি ঝি পোকার তান শুনতে হবে। নাকে লাগাতে হবে পাকা আম-কাঁঠালের ঘ্রাণ। নিস্তব্ধ নিরালা দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনতে হবে। যেতে হবে গ্রামীণ মেলায়।

বৈশাখ এলে মনে অনুরণন তোলে কবিগুরুর সেই চিরায়ত সঙ্গীতটি:
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো…।’

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক পার্বণের বিচিত্র সমারোহে জড়িয়ে থাকা প্রকৃতির এক লীলাময় পর্ব। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া বৃক্ষের শাখায় শাখায় লাল-হলুদ ফুলের রঙিন উচ্ছ্বাস যেন বর্ণিল ট্যাপেস্ট্রি। বৈশাখের ভোরের হাওয়া মনের চিরন্তন রূপের বর্ণালী ছড়াতে আরেক দিনের প্রভাত নতুনের বাণী শুনিয়ে হৃদয়ে স্পন্দন তোলে। স্তব্ধ দুপুরের কাঠফাটা রোদেলা প্রকৃতি মনে বিচিত্র দোলা দিয়ে যায়।

পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের সার্বজনীন উৎসব। দেশে এবং সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীতের দুঃখ-গ্লানি।

উত্তরাধুনিক পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।

♣♣♣

বৈশাখী রোদের আড়াআড়ি

পথে যেতে হবে
বেলা অবেলায়
তবে পাতায় লেগে থাকে
খানিকটা ধুলো।
নতুন বছর এলো
খেরোখাতায় সব এলোমেলো
পাতাখেকো পোকা
ঝরাপাতা খুঁটে খেলো।
এখন অন্ধকার রাত
বিনা মেঘে বজ্রপাত
আকাশে ছিলো না
মেঘের গোজর।
একা একা পথে হাঁটি
আকাশ দেখি পরিপাটি
কখন আঁধার কেটে
আসে ভোর।
সূর্য দীঘল বাড়ি
রোদ আড়াআড়ি
বেড়েছে বাতাসের জোড়।
আজি বৈশাখী  বাতাসে
ফুলের গন্ধ ভেসে আসে
দূর পাহাড়ে বাঁধা
মায়াবী ডোর ।

♣♣♣

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

পহেলা বৈশাখ সংখ্যা

আপডেট সময়: ০৬:০৫:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

 উত্তরাধুনিক ডেস্ক: বাংলার বৈশাখের দু’টি দিক আছে–প্রাকৃতিক আর উৎসবীয় দিক। সাধারণত বৈশাখ বলতে আমাদের সংস্কার ও মানসে উৎসবীয় আমেজটাই আগে এসে যায় প্রথমে। আমরা ঋতু পালাবদলের দিকটা তেমনভাবে অনুভব করি না, বিশেষত শহরাঞ্চলে দালানকোঠা ও ব্যস্ত জীবনের আড়ালে বৈশাখের প্রাকৃতিক রূপ ও সৌন্দর্য অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়। তবে উৎসবের আমেজে, কুশল বিনিময়ে, মেলায়, পান্তা ও শহুরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শহর গমগম করে। শহরে বসে কি আর বৈশাখের পরিপূর্ণ আবহ মেলে? বৈশাখ, তথা যেকোনো ঋতু পরিবর্তনের আমেজ পেতে গ্রামে যেতে হবে। বসে থাকতে হবে আম-কাঁঠাল গাছের ছায়ায়। দেখতে হবে ইশান কোণে হঠাৎ জেগে ওঠা কালো ছায়া। রাতে শুয়ে ঝি ঝি পোকার তান শুনতে হবে। নাকে লাগাতে হবে পাকা আম-কাঁঠালের ঘ্রাণ। নিস্তব্ধ নিরালা দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনতে হবে। যেতে হবে গ্রামীণ মেলায়।

বৈশাখ এলে মনে অনুরণন তোলে কবিগুরুর সেই চিরায়ত সঙ্গীতটি:
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো…।’

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক পার্বণের বিচিত্র সমারোহে জড়িয়ে থাকা প্রকৃতির এক লীলাময় পর্ব। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া বৃক্ষের শাখায় শাখায় লাল-হলুদ ফুলের রঙিন উচ্ছ্বাস যেন বর্ণিল ট্যাপেস্ট্রি। বৈশাখের ভোরের হাওয়া মনের চিরন্তন রূপের বর্ণালী ছড়াতে আরেক দিনের প্রভাত নতুনের বাণী শুনিয়ে হৃদয়ে স্পন্দন তোলে। স্তব্ধ দুপুরের কাঠফাটা রোদেলা প্রকৃতি মনে বিচিত্র দোলা দিয়ে যায়।

পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের সার্বজনীন উৎসব। দেশে এবং সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীতের দুঃখ-গ্লানি।

উত্তরাধুনিক পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।

♣♣♣

এসো হে বৈশাখ

হাসান জাহিদ

বছর ঘুরে বাঙালির জীবনে এলো আরও একটি বৈশাখ। বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি  বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়।

বৈশাখে এলে মনে অনুরণন তোলে কবিগুরুর সেই চিরায়ত সঙ্গীতটি:

‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো…

যাক পুরাতন স্মৃতি
যাক ভুলে যাওয়া গীতি
যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
যাক যাক
এসো এসো…।’

আর নব্বই দশকের শেষার্ধ থেকে এখনও পর্যন্ত ‘মেলাই যাইরে’ গানটি জনপ্রিয়। ফিডব্যাকের ‘মেলায় যাইরে’ গানটির লিরিকের কিছু অংশ:

‘মেলায় যাইরে. লেগেছে বাঙালীর ঘরে ঘরে একি মাতনদোলা

লেগেছে সুরেরই তালে তালে হৃদয় মাতনদোলা.

বছর ঘুরে এল আরেক প্রভাতী ফিরে এলো সুরেরই মঞ্জুরী

পলাশ শিমুল গাছে লেগেছে আগুন

এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি মেলায় যাইরে।’

বাংলার বৈশাখের দু’টি দিক আছে–প্রাকৃতিক আর উৎসবীয় দিক। সাধারণত বৈশাখ বলতে আমাদের সংস্কার ও মানসে উৎসবীয় আমেজটাই আগে এসে যায় প্রথমে। আমরা ঋতু পালাবদলের দিকটা তেমনভাবে অনুভব করিনা, বিশেষত শহরাঞ্চলে দালানকোঠা ও ব্যস্ত জীবনের আড়ালে বৈশাখের প্রাকৃতিক রূপ ও সৌন্দর্য অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়।

অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল  হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। হালখাতা অনুষ্ঠান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে এখনও হয়, তবে সীমিত সংখ্যায়।

অতীতে গবাদি পশুকে স্নান করানো, অতিথি বরণ প্রভৃতি প্রথা ছিল খুবই সুপরিচিত প্রথা।

 বউমেলা

ঈশা খাঁর সোনারগাঁয় ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম ‘বউমেলা’। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পয়লা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজোর জন্য এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা। পাঁঠাবলির রেওয়াজও পুরনো। বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে। বউমেলায় কাঙ্ক্ষিত মানুষের খোঁজে কাঙ্ক্ষিত মানসীর প্রার্থনা কিংবা গান্ধর্ব প্রণয়ও যে ঘটে না সবার অলক্ষে, তা কে বলতে পারবে।

 ঘোড়ামেলা

এ ছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ঘোড়ামেলা। লোকমুখে প্রচলিত যামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ওই স্থানেই তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে প্রচলিত মেলাটির নাম ঘোড়ামেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। সকাল থেকেই এ স্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। এক দিনের এ মেলাটি জমে ওঠে দুপুরের পর থেকে। হাজারো লোকের সমাগম ঘটে। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারণে এ মেলার আয়োজন করা হয়। তথাপি সব ধর্মের লোকজনেরই প্রাধান্য থাকে এ মেলায়। এ মেলায় শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি থাকে। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নানারকম আনন্দ-উৎসব করে পশ্চিমের আকাশ যখন রক্তিম আলোয় সজ্জিত উৎসবে, যখন লোকজন অনেকটাই ক্লান্ত, তখনই এ মেলার ক্লান্তি দূর করার জন্য নতুন মাত্রায় যোগ হয় কীর্তন। এ কীর্তন হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এভাবেই শেষ হয় বৈশাখের এই ঐতিহ্যবাহী মেলা।

কোলকাতা

ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কোলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম ‘চৈত্র সেল’। তাই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবং এই ছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করতে অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে কলকাতার সমস্ত মানুষ একমাস ধরে নতুন জামাকাপড়, ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে।

বাংলা ১৪৩২ সনের পহেলা বৈশাখ বয়ে আনুক সবার মাঝে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।

♣♣♣

প্রাণের বৈশাখ

আতোয়ার রহমান

বাঙালির জীবনে উৎসবের রং ছড়িয়ে বছর ঘুরে আবার এল পয়লা বৈশাখ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুনামগাঞ্জ থেকে চুরুলিয়া, টোকিও থেকে টরন্টো পর্যন্ত আজ ভাসবে বিপুল আনন্দের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। সবাই যোগ দেবেন বাংলাদেশের জনগনের সবচেয়ে বড় সার্বজনীন উৎসব বৈশাখী উৎসবে। বাঙালির কন্ঠে আজ ছড়িয়ে যাবে বাংলা নতুন বছরকে সম্ভাষণ  জানিয়ে রচিত রবি ঠাকুরের সঙ্গীতের সেই চেনা সুর ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…। ‘

বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন আজও ধর্ম ও সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সব শ্রেণীর বাঙালির জাতীয় উৎসব। পয়লা বৈশাখ ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের দিন হিসেবে একেবারেই আমাদের মাটি আর মানুষ থেকে উৎসারিত। এটি আমাদের আপন সাংস্কৃতিক চেতনা ও ঐতিহ্যের স্মারক, আপন জাতিসত্তায় অনুপ্রাণিত  হওয়ার উৎস, জাতীয় ঐক্যবোধে দীপ্ত হওয়ার উপলক্ষ, জাতির প্রতিচ্ছ্ববি। বাঙালির বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের প্রতিক পয়লা বৈশাখ। দিন দিন এই উৎসব উদযাপনের ব্যাপকতা বৃদ্বি পাচ্ছে।

মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়কে ঘিরে বাদশাহ আকবরের সময় এর প্রচলন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বানিজ্যের হালখাতার বিষয়টি। যদিও আজকাল হালখাতায় বাকিবকেয়া পরিশোধের প্রবণতা কমে গেছে। পয়লা বৈশাখের উৎসব শুরুর দিকে ছিল গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক; এখন শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জ–সারা দেশে চলে প্রাণের জোয়ার। চারিদিকে নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস। পথে পথে উৎসব প্রিয় বাঙালির ঢল। মাটির হাঁড়ি, আলপনা, নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ঢোলের বাদ্য, আর বাঁশির সুর।

তরুণেরাই এখন এ উৎসবের প্রাণ। তরুণেরা এখন বিভিন্নভাবে এ উৎসবকে পুনরাবিস্কার করছেন। চৈত্র শেষ হতে না হতেই সব তরুণের মনে উৎসবের রঙ জমে। তাঁরাই উৎসবের রঙ ছড়ায় সবখানে, গান বাজায় প্রাণে প্রাণে।  এ উৎসবের ভিত্তিটা  গড়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষক সমাজ। তরুণ-তরুণীরা বৈশাখী উৎসবের রঙিন পোশাক পরে বেরিয়ে আসে। তরুনীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, কাচের চুড়ি, ফুলের মালায় সাজবে, তরুণদের পরনে থাকবে রঙিন পাঞ্জাবি, ফতুয়া, পায়জামা।

এধরণের একটি শেকড়ধর্মী উৎসব  সংস্কৃতির ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয়ে  সহায়তা করে তারুণ্যকে নানা ধান্দাবাজি ও অপরাজনীতির কবলে পড়ে বিভ্রান্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করবে। এ উৎসব আমাদের আপন সংস্কৃতি লালন ও নিজেদের মধ্যে তা বিকশিত করার নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করবে, বিদেশি অপসংস্কৃতি থেকে দূরে রাখবে আমরা এই প্রত্যাশা করি। তবে কর্পোরেট বানিজ্যের আগ্রাসি থাবা থেকে এ উৎসবের মূল সুরকে রক্ষা করার ব্যাপারে আমাদের সকলকে সজাগ থাকতে হবে। মিডিয়ার সাহায্যে কোম্পানিগুলো আমাদের প্রাণের এই উৎসবকে যেনো বিপণনযোগ্য আইটেমে পরিণত করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমাদের সকলকে সচেতন থাকতে হবে।

শুধু দেশে নয়, বিদেশে বসবাসকারি বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাঙালির মধ্যেও  বৈশাখ নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই।  পহেলা বৈশাখ নিয়ে দেশের মধ্যে যে উদ্দীপনা, তার চেয়ে  বিশ্বের সর্বত্র মাকড়সার জালের মত ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের মোটেও কম নয়।  শুধু প্রথম প্রজন্ম নয়, ভিন্ন ভাষা আর সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা প্রবাসের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও বেশ আন্তরিকতা ও মমতার সাথে এসব উৎসব অনুষ্ঠান ও অংশগ্রহন করে থাকে। প্রবাসে  জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা বাঙালি প্রজন্মকে জাতির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও এর ইতিহাসের সঙ্গে  পরিচয় করিয়ে দেয় এ উৎসব। এখানে কানাডাতেও বৈশাখী মেলা ৫-৬ দিনব্যাপী হয়। অনেক ধরণের মেলা হয়, পিঠা উৎসব হয়, ঢাকার চারুকলার আদলে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। সামাজিক সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আয়োজনে মনোজ্ঞ  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলার  আয়োজন করা হয়,  মেলা ও অনুষ্ঠানস্থল  একেবারে লোকারণ্য হয়ে যায়। যদিও প্রবাসে কালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়া বহে না, কালোমেঘ ধেয়ে এসে কোন ধুলিঝড়ের সৃষ্টি করেনা তবুও বাঙালিরা  উৎসবে মেতে ওঠার ক্ষেত্রে কোনক্রমেই পিছিয়ে থাকেনা। এর মধ্যে তারা খুঁজে পায় তাদের শৈশবে দেখা নদীর ধারের  গ্রাম্য মেলার স্মৃতি, তাদের হারানো শিকড়, হারানো ঐতিহ্য, ফেলে আসা দেশ।

ঐতিহ্যবাহী দেশি খাবারের উৎসব চলে। খাবার দাবারেও  প্রাধান্য পাবে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পছন্দের খাবারগুলো। পান্তা, ইলিশ, বিভিন্ন রকমের ভর্তা, ভাজি, আচার, চাটনি, চটপটি, খই-মুড়ি-মুড়কি, জিলাপি, খোরমা, বাতাসা-মন্ডা-বুন্দিয়া, আরো কত কী! বছরের প্রথম দিনটি উদর পূর্তি কোঁরে কাটিয়ে দিবে উৎসবে গা ভাসানো আপামর বাঙালি।

সাধারণ মানুষের আশা নতুন বছরে নতুন সুখ-সমৃদ্বির শুরু হবে, জীবনযাপনের মান আরও উন্নত হবে, অশুভের দমন করা হবে। নতুন বছরটি সবার ভালভাবে কাটবে। সকলের জীবনে শান্তি আসবে, সমাজ ও রাজনীতি সুস্থ হবে, দূষণমুক্ত হবে। তাদের যাপিতজীবনে অনন্ত আনন্দধারা বয়ে যাক। সমস্ত বিভেদ ও অনৈক্য ভুলে গিয়ে আমরা যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি বিশ্বসভায়। একটি সুখি ও শান্তিপূর্ণ সমাজের আশায় সকলকে আবারও নববর্ষের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।

♣♣♣

আমাদের বৈশাখ

দিলারা শাহীন শোভা

ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে

বাংলার বৈশাখের দু’টি দিক আছে–প্রাকৃতিক আর উৎসবীয় দিক। সাধারণত বৈশাখ বলতে আমাদের সংস্কার ও মানসে উৎসবীয় আমেজটাই আগে এসে যায় প্রথমে। আমরা ঋতু পালাবদলের দিকটা তেমনভাবে অনুভব করি না, বিশেষত শহরাঞ্চলে দালানকোঠা ও ব্যস্ত জীবনের আড়ালে বৈশাখের প্রাকৃতিক রূপ ও সৌন্দর্য অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়। তবে উৎসবের আমেজে, কুশল বিনিময়ে, মেলায়, পান্তা ও শহুরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শহর গমগম করে। শহরে বসে কি আর বৈশাখের পরিপূর্ণ আবহ মেলে? বৈশাখ, তথা যেকোনো ঋতু পরিবর্তনের আমেজ পেতে গ্রামে যেতে হবে। বসে থাকতে হবে আম-কাঁঠাল গাছের ছায়ায়। দেখতে হবে ইশান কোণে হঠাৎ জেগে ওঠা কালো ছায়া। রাতে শুয়ে ঝি ঝি পোকার তান শুনতে হবে। নাকে লাগাতে হবে পাকা আম-কাঁঠালের ঘ্রাণ। নিস্তব্ধ নিরালা দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনতে হবে। যেতে হবে গ্রামীণ মেলায়।

বৈশাখ এলে মনে অনুরণন তোলে কবিগুরুর সেই চিরায়ত সঙ্গীতটি:
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো…।’

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক পার্বণের বিচিত্র সমারোহে জড়িয়ে থাকা প্রকৃতির এক লীলাময় পর্ব। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া বৃক্ষের শাখায় শাখায় লাল-হলুদ ফুলের রঙিন উচ্ছ্বাস যেন বর্ণিল ট্যাপেস্ট্রি। বৈশাখের ভোরের হাওয়া মনের চিরন্তন রূপের বর্ণালী ছড়াতে আরেক দিনের প্রভাত নতুনের বাণী শুনিয়ে হৃদয়ে স্পন্দন তোলে। স্তব্ধ দুপুরের কাঠফাটা রোদেলা প্রকৃতি মনে বিচিত্র দোলা দিয়ে যায়।

পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের সার্বজনীন উৎসব। দেশে এবং সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীতের দুঃখ-গ্লানি।

উত্তরাধুনিক পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।

♣♣♣

বৈশাখী রোদের আড়াআড়ি

পথে যেতে হবে
বেলা অবেলায়
তবে পাতায় লেগে থাকে
খানিকটা ধুলো।
নতুন বছর এলো
খেরোখাতায় সব এলোমেলো
পাতাখেকো পোকা
ঝরাপাতা খুঁটে খেলো।
এখন অন্ধকার রাত
বিনা মেঘে বজ্রপাত
আকাশে ছিলো না
মেঘের গোজর।
একা একা পথে হাঁটি
আকাশ দেখি পরিপাটি
কখন আঁধার কেটে
আসে ভোর।
সূর্য দীঘল বাড়ি
রোদ আড়াআড়ি
বেড়েছে বাতাসের জোড়।
আজি বৈশাখী  বাতাসে
ফুলের গন্ধ ভেসে আসে
দূর পাহাড়ে বাঁধা
মায়াবী ডোর ।

♣♣♣