০৭:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

বাঘের ইচ্ছে হলেই সম্ভব

  • আপডেট সময়: ১১:৫৫:৫৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ এপ্রিল ২০২৫
  • 22
শামীমুল হক

বাঘের সঙ্গে মোলাকাত ক’জনের হয়েছে? সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখাই কি শেষ কথা? খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জুড়ে সুন্দরবনের বিস্তৃতি। এটা শুধু বাংলাদেশ অংশ। ভারতের অংশেও রয়েছে সুন্দরবনের একাংশ। দুই দেশ মিলে দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠেছে এই সুন্দরবন। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছয় হাজার সতের বর্গ কিলোমিটার। মোট কথা সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে। বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। আমরা যখন খুলনা থেকে জাহাজে উঠি রাত তখন প্রায় তিনটা। প্রত্যেকেই যার যার কেবিনের চাবি বুঝে নিয়ে রুমে চলে যাই। প্রত্যেক রুমে রয়েছে স্পিকার। হঠাৎ স্পিকারে বলতে শোনা যায়Ñ সকাল আটটায় নাস্তার পর সুন্দরবন নিয়ে একটা ধারণা দেয়া হবে। সবাইকে যথাসময়ে জাহাজের তিন তলায় খাবারের রুমে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানান ঘোষক। জাহাজ চলছে নদীর মাঝ দিয়ে। দু’পাশে সুন্দরবন। এমন অপরূপ দৃশ্য? কোনো মানুষের পক্ষে কি এভাবে সাজানো সম্ভব? আসলে প্রকৃতির এমন উপহার মানুষের জন্য। তাই তো দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ ছুটে চলে সুন্দরবন দেখতে। বাঘের দেখা পেতে। কিন্তু বাঘের দেখা পাওয়া আর পাহাড় ঠেলা সমান কথা। কারণ যেদিকে বাঘ থাকে সেদিকে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয় না। এটা অঘোষিত একটা নিয়ম। তিন দিনের সুন্দরবন সফরে এমনটাই মনে হলো। আর সকালে গাইড আল-আমিনের কথায় এটা আরও স্পষ্ট হলো। নাস্তা পর্ব শেষে সবাই যার যার টেবিলে বসা। জাহাজ চলছে বিরতিহীনভাবে। গাইড আল-আমিন এসে দাঁড়ালেন একটি টিভির সামনে। গুডমর্নিং সবাইকে। আমি গাইড আল-আমিন। তিনদিন আপনাদের সঙ্গে থাকবো। সুন্দরবনের রহস্য কথায় এগিয়ে যাবো সামনে। এই যে সুন্দরবন এটা বাঘের অভয়ারণ্য। আর সুন্দরবনের বাঘ পৃথিবীর সকল বাঘের চেয়ে আলাদা। আমি প্রায় নয় বছর ধরে গাইড হিসেবে সুন্দরবনে রয়েছি। এই যে জাহাজ এটি একেবারেই নতুন। পাঁচ মাস হলো নামানো হয়েছে। এখন এখানে আছি। বহু পর্যটকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আলাপ হয়েছে। বন্ধুত্ব হয়েছে। কিন্তু এই নয় বছরে আমি কোনো বাঘ দেখতে পাইনি। তাই বলে আপনারা হতাশ হবেন না। ভাগ্য ভালো থাকলে একদিনেই আপনারা বাঘ দেখতে পাবেন। এমনটা হয়েছে শুনেছি। আল-আমিনের কথায় বুঝা গেল বাঘ দেখাটা আসলে দুরূহ। কারণ যেদিকে বাঘ থাকে সেদিকে পর্যটকদের নিয়েই যাওয়া মানা।

আল-আমিন স্পষ্ট করে না বললেও আন্দাজ করা যায়। সুন্দরবনের হরিণের কথাও বললেন তিনি। পাখ-পাখালির কথাও বাদ যায়নি। টিভি স্ক্রিনে ভেসে ওঠলো  মানচিত্র। আমরা কোন কোন নদী দিয়ে কোথায় যাবো। এমন সময় আল-আমিন জানালেন আগামীকাল আমরা কটকায় যাবো। তবে আপনাদের জন্য সুখবর হলো কটকায় হেঁটে যেতে পারবেন। যেখানে জাহাজ থামবে সেখান থেকে সাড়ে ৯ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হবে। আর যারা যাবেন না তারা জাহাজেই থাকবেন। জাহাজও একই সঙ্গে ছাড়বে। এই সাড়ে ৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জাহাজ গিয়ে থামবে। ওদিকে যারা হেঁটে যাবেন তারাও সেখানে গিয়ে একসঙ্গে মিলিত হবেন। হেঁটে যাওয়া পথের তিন কিলোমিটার জঙ্গল। তিন কিলোমিটার বিস্তীর্ণ চর। আর তিন কিলোমিটার সাগর। অন্যরকম এক ফিলিংস এই হেঁটে যাওয়ার। যারা গিয়েছেন তারা বলেছেন, এমন স্মৃতি মনের গহীনে গেঁথে থাকবে আজীবন। যারা যাননি তারা বড্ড মিস করেছেন। গাইড আল-আমিন বলেই যাচ্ছিলেন সুন্দরবনের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা। এই তিনদিন আমরা কোথায় কোথায় যাবো। কীভাবে যাবো। সবই বলা হলো। পরদিন ভোর ৬টায় পাখি দেখতে যারা যাবেন তাদের কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। কি করতে হবে সবই বললেন। কুমির প্রজনন কেন্দ্রে গিয়ে কি করতে হবে। কীভাবে চলতে হবে। আল-আমিনের সব মুখস্থ। সবশেষে বললেন, এরপরও যদি কারও কিছু জানার থাকে আমাকে বলবেন। আমি সর্বদা আপনাদের সেবায় নিয়োজিত।  কথায় কথায় জাহাজ গিয়ে থামলো হাড়বাড়িয়া পয়েন্টে। এবার আল-আমিন বললেন, এবার আমরা হাড়বাড়িয়া পয়েন্টে যাবো। ঘুরে দেখবেন জীব বৈচিত্র্য। খুলনা চার নম্বর ঘাট থেকে যে ট্রলারে করে আমরা দূরে অপেক্ষারত জাহাজে গিয়ে উঠেছিলাম সেই ট্রলার আর জাহাজ ছাড়েনি। ট্রলার বেঁধে দেয়া হয় জাহাজের সঙ্গে। যেখানেই যাই জাহাজ মাঝ নদীতে থেমে যায়। তারপর ট্রলার নিয়ে যায় তীরে বা কোনো স্পটে। আমরাও এবার জাহাজ থেকে নেমে ট্রলারে গিয়ে বসলাম। উদ্দেশ্য হাড়বাড়িয়া পয়েন্ট দেখা। চার কিংবা পাঁচ মিনিট চলার পরেই হাড়বাড়িয়া পয়েন্ট। ট্রলার থেকে একে একে সবাই নামলাম। প্রবেশ পথেই বানরের দেখা। দলবদ্ধ বানরের দল। এত মানুষ দেখেও বানরগুলোর কোনো ভয় নেই। বরং আমাদের এক সহযাত্রীকে আক্রমণ করে বসে। গাইড আগে এগুচ্ছে আমরা পেছনে পেছনে। যতই এগুচ্ছি সামনে গহীন জঙ্গল। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে বাঘ দেখা যায় কিনা? ভয়ও কাজ করছে সবার মনে এই বুঝি বাঘ হামলে পড়ছে কারও না কারও ওপর। ভয় আর আতঙ্কে হিমশীতল হয়ে আসছিল শরীর। অন্যদিকে সুন্দরবন দেখার আনন্দও ছিল মনে। মাঝে মাঝে গাইড চিৎকার করে বলছিলেন সবাই  একসঙ্গে থাকেন। কেউ একা হবেন না। তাহলে বিপদ হতে পারে। হাড়বাড়িয়া পয়েন্টটি খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দুই কিলোমিটার জঙ্গলের ভেতরে গিয়েও বাঘের দেখা পাওয়া যায়নি। যা দেখা গেছে তা হলো বাঘের পায়ের ছাপ। আর ছাপ কোথায়? যে পথে মানুষ চলাচলের জন্য সুন্দর করে ইটপাথরের সুড়কি দিয়ে বানানো হয়েছে তার পাশেই। মানুষ যেন চলাচল করতে পারে সেজন্য এ পথ বানানো হয়েছে উঁচু করে পিলারের উপর। দুই পাশে আবার রেলিং দেয়া।

হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ পর পর দেখা যাচ্ছিল বাঘের পায়ের ছাপ। আসলেই কি এটা বাঘের পায়ের ছাপ? এখানেও রয়েছে রহস্য। কথিত রয়েছে, বন বিভাগ থেকে এক ধরনের অস্ত্রের মাধ্যমে এমন ছাপ দেয়া হয়। পর্যটকরা যাতে পায়ের ছাপ দেখে শিহরিত হন। বাঘ না দেখলেও পায়ের ছাপ দেখেছি-এটা ভেবে তৃপ্তি পান। এমন তৃপ্তি নিয়েই হাজার হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসেন নিজ গন্তব্যে। বেশক’টি নদী ঘিরে রেখেছে সুন্দরবনকে। এর সবক’টিই জোয়ার- ভাটার নদী। তাই জোয়ারে সুন্দরবনে পানি জমে। আবার ভাটায় সেই পানি নেমে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে জোয়ারের পানিতে যেন গাছ না মরে এ প্রতিটি গাছই তাকে রক্ষায় শ্বাসমূল ছড়িয়ে দেয়। ছোট থেকে বড় বহু শ্বাসমূল ঘিরে রাখে প্রতিটি গাছকে। গাইড আল-আমিন সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলটি দেখিয়ে বলেন, এটি সবচেয়ে বড়। মানে হলো জোয়ারে পানি এ শ্বাসমূলের উপরে উঠে না। জোয়ারের সময় গাছ এ শ্বাসমূল থেকে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে। হাড়বাড়িয়া পয়েন্টেই ছোট খালে এক প্রকার মাছ দেখা যায়। এ মাছগুলোর সামনে গিয়ে গাইড আল-আমিন এ মাছের বিশদ বর্ণনা দেন আমাদের। এ মাছ জলে ও স্থলে বসবাস করে। সামনেই একটি পুকুর। পুকুরে পানি থৈ থৈ। নিশ্চয় জোয়ার- ভাটায় এ পুকুরও ডুবে ও ভাসে।

সুন্দরবন নাম হয়েছে সুন্দরী গাছের কারণে। কিন্তু সুন্দরী গাছ কীভাবে সুন্দর তা বোঝা গেল না। তবে তার একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সুন্দরী গাছের গোড়া এমনভাবে নিজ থেকে তৈরি যা দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। গাছটিকে যেন চারদিক থেকে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। যেন ভেঙে না যায়। কারণ সুন্দরী গাছ একেবারে লম্বা ও সোজা হয়। এর কোনো ডালপালা নেই। একেবারে লক-লকিয়ে এগিয়ে গেছে উপরে। প্রচণ্ড বাতাসেও এ গাছ ভেঙে পড়ে না। কারণ তার গোড়ায় নিজ থেকেই মোটা মোটা জড় ঠেস দিয়ে রেখেছে। আসলেই প্রকৃতির কী খেলা! প্রত্যেকেই নিজেকে বাঁচানোর উপায় নিজেই খুঁজে নেয়। সুন্দরী গাছও তেমন। আর এ সুন্দরী গাছ বেশি দেখা যায় আন্দারমানিক পয়েন্টে। হাড়বাড়িয়া ভ্রমণ শেষে আন্দারমানিকের উদ্দেশ্যে যাত্রা। শুরুতেই বাঘের ছবি দিয়ে বিরাট নিয়ন সাইনের পোস্টার সাঁটানো। এ বাঘ দেখেই আন্দারমানিক স্পটে প্রবেশ। শুরুতেই বিশাল এক উঁচু টাওয়ার। এর নাম ডলফিন টাওয়ার। এ টাওয়ার থেকে নদীতে ডলফিন দেখা যায় বলে এর নাম রাখা হয়েছে ডলফিন টাওয়ার। সহযাত্রীদের অনেকেই ডলফিন দেখতে এ টাওয়ারে উঠেন। তাদের দু’চোখ নদীর দিকে বড় বড়  চোখ নিয়ে তাকানো। ডলফিন দেখার স্বপ্ন এ চোখে। কিছুক্ষণ পর একে একে সবাই নেমে এলেন। কি ভাই ডলফিন দেখেছেন। কেউ কোনো কথা বলছে না। অবশ্য গাইড আল-আমিন কথার মারপ্যাঁচ জানেন ভালো। আগেই বলে নিয়েছিলেন ডলফিন টাওয়ারে উঠলে ডলফিন দেখা যেতেও পারে। নাও পারে। যাদের ভাগ্য ভালো তারা ডলফিন দেখতে পায়। এই আন্দারমানিকে বেশক’টি হরিণ আটকে রাখা হয়েছে। বাউন্ডারির বাইরে থেকে ডাক দিলে হরিণগুলো ছুটে আসে। কেউ কেউ এসব হরিণকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অবশ্য জাহাজ চলাকালীন সুন্দরবন থেকে অনেক হরিণ নদীতে পানি খেতে এসেছে তা দেখা গেছে। আন্দারমানিকের প্রায় দেড় কিলোমিটার  ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে সব সুন্দরী গাছের আখড়া।

এবার পশু-পাখি দেখার পালা। জাহাজ এক জায়গায় গিয়ে থামলো। সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো সকাল ৬টায় ট্রলার পশু-পাখি দেখার জন্য যাবে। যথাসময়ে সবাই ট্রলারে গিয়ে উঠলেন। ট্রলার ছাড়লো। একটু সামনে গিয়ে মূল নদীর শাখা দিয়ে প্রবেশ করলো ট্রলার। একটি খালের মতো। সবার নজর খালের দু’পাশের গাছের দিকে। পাখি দেখার জন্য। কিন্তু না! কোনো পাখিই দেখা যাচ্ছিল না। কিছু দূর যাওয়ার পর একজন এসে বললেন, ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে দাও। আস্তে আস্তে চলুক। ইঞ্জিনের শব্দে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। সত্যিই তাই। ইঞ্জিন বন্ধ করে ট্রলার এগুতে থাকে। এবার পাখির কিচিরমিচির শব্দ কানে আসছে। আসছে বন মোরগের ডাক। সত্যিই পাখ-পাখালির এমন ডাক মন ছুঁয়ে যায়। কিন্তু খালের পাশের কোনো গাছেই পাখির চিহ্নটি পর্যন্ত নেই। ফেরার পথে আবার একই দৃশ্য। চোখ বড় করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই। কিন্তু না পাখির দেখা মিললো না। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর বন মোরগের ডাক পুঁজি করেই ফিরে আসা জাহাজে। সেখান থেকে করমজাল যাওয়া। যেখানে রয়েছে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সেখানে গিয়ে দেখা মিললো ছোট ছোট দোকানপাটের। দোকানিরা এসেছেন মোংলা থেকে। করমজালে আসা পর্যটকদের কাছে তাদের পণ্য বেচতে। পণ্য বলতে পানি, চা, রুটি, পেয়ারা, শসা, পানীয়। কিন্তু সবই ডাবল দাম। আবার সেখানে হরিণের খাবার বিক্রি হচ্ছে। মানুষ লাইন ধরে খাবার কিনছে। হরিণকে খাবার দিবে বলে। করমজালে হরিণ, বানর সবই আছে। তবে কুমির দেখতেই এখানে ভিড় বেশি। করমজালের নদীতেও কুমিরের আস্তানা। করমজালের ভেতরে একটি পুকুর আছে। এ পুকুরেই প্রথম আনা হয় রোমিও আর জুলিয়েট কুমির জুটিকে। কিন্তু রোমিও আর জুলিয়েট প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে জুলিয়েটকে বন্দি করে রাখা হয় একটি খাঁচায়। আর রোমিওকে নদীতে ছেড়ে দেয়া হয়। রোমিও যেন তার আর কোনো সঙ্গীকে বেছে নিতে পারে। কিংবা সে তার পথ নিজেই বেছে নিবে। বেশক’টি খাঁচায় ছোট কুমির আর বড় কুমির। পুকুরের পাড়ে গিয়ে দেখা গেল বড় দুটি কুমির পানি থেকে পাড়ে উঠে ঘুমিয়ে আছে। একটি উল্টো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। প্রথম দেখায় মনে হয়েছে মরে আছে। এত মানুষের হইচই তবু কুমিরের ঘুম ভাঙছে না। মনে মনে ভাবলাম এ জন্যই বুঝি বলা হয়, কুমিরের ঘুম ঘুমিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর একটি কুমির সজাগ হয়ে দ্রুত পুকুরে নেমে যায়। অন্যটি মরার মতো ঘুমিয়েই আছে। ফেরার পথে সেখানকার ডাব খেয়ে একে একে সবাই ট্রলারে উঠেন। এরপর ট্রলার নিয়ে যায় আমাদের জাহাজে।

সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে হলেও এ অংশে নাকি বাঘ আছে ১২৫ কি ১২৮টি। আর ভারতের অংশে ৪০ শতাংশ হলেও সেখানে বাঘ রয়েছে ৪০০-এর উপরে। আচ্ছা বাঘ কীভাবে গণনা করে। এ নিয়ে মনে প্রশ্ন। শুধু আমার নয়, অনেকের মনেই এ প্রশ্ন। আর বাঘের সংখ্যা যে বলা হয় এটা কতোটুকু সত্যি? এ নিয়ে অনেক কিছু লেখা যায়। তবে লিখলে বাঘ গণনায় যে বাজেট তাতে টান পড়বে। তারচেয়ে বরং যে হিসাব দেয়া হয় সেটা মেনেই সবার চলা উচিত। চলছেও।  সুন্দরবন পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন যেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাস করে। কিন্তু এ বনে বাঘের দেখা মেলা অন্য যেকোনো বনের চেয়ে বেশ দুরূহ। সুন্দরবনে দিনে দু’বার জোয়ার-ভাটা হয়। এখানে মোটরবোটে চড়ে বন দেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তবে প্রায়ই রিপোর্ট হয় কোনো না কোনো সময়ে জেলে, কাঁকড়া শিকারী, মধু আহরণকারী ও গোলপাতা আহরণকারীরা বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন।
সুন্দরবনে কথা হয় এক গোলপাতা আহরণকারীর সঙ্গে। তাকে বাঘের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ওই যে বাঘের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে একটা বাঘ এখান দিয়ে গেছে। কথায় কথায় তিনি বলেন, বাঘ দেখবেন কোথা থেকে? বাঘের নির্দিষ্ট একটি এলাকা আছে।  সে এলাকায় আপনারা যেতে পারবেন না। তবে একটা কথা শুনে রাখুন সুন্দরবনে কেবল বাঘের ইচ্ছে হলেই মানুষ তাকে দেখতে পায়। করমজালে কথা হয় মামুনের সঙ্গে। তার বাড়ি মোংলায়। প্রতিদিন নদী পার হয়ে করমজালে আসে। পেয়ারা-শসা আর বড়ই বিক্রি করছে এখন। বেশির ভাগ সময় মৌসুমি ফলমূলই বিক্রি করে। মামুনের কথাÑ সুন্দরবনের আনাচকানাচ তার নখদর্পণে। তার মতো এখানকার বাসিন্দাদের কাছে বাঘ হচ্ছে ‘মামা’। সকালে বেরুনোর আগে বনবিবির কাছে প্রার্থনা করে বেরিয়েছে মামুন।  সুন্দরবনের নরম মাটিতে বাঘের পায়ের চিহ্ন কয়েক ইঞ্চি ডুবে আছে। যেন কিছুক্ষণ আগে কেওড়ার শ্বাসমূল বাঁচিয়ে নেমে এসেছিল বাঘ। হাড়বাড়িয়া পয়েন্টের একজন কর্মচারী ফ্যাকাসে মুখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো। ‘মানুষখেকো, বেজায় চালাক। গত সপ্তাহে এক জেলের ওপর হামলা চালিয়েছিল। বেচারা ছুরি দিয়ে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বাঘটিই তার দফারফা করে ফেলে। তার কথা কানে আসতেই আমি ঢোক গিললাম। আগেই বলেছি দিনের মধ্যে দু’বার সুন্দরবন পানির নিচে ডুবে যায়। এখানকার বাঘদের তখন লবণাক্ত পানি পান ও আধা-জলজ জীবনযাপন করতে হয়। এ কারণে সুন্দরবনের বাঘ দক্ষ সাঁতারুও। এ বনের বাঘের লেজ শক্ত ও পেশিবহুল। সাঁতারের সময় পানিতে লেজ ঝাপটায় এটি। সুন্দরবনের বাঘ অন্য জায়গার বেঙ্গল টাইগারের মতো নয়। এর খাদ্যাভ্যাসও অন্যদের থেকে ভিন্ন। এ বনের বাঘেরা মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ, বড় গুঁইসাপ ইত্যাদিও শিকার করে। সুন্দরবনের বাঘের সাপ শিকার করারও নজির আছে। তবে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। ক’দিন আগে একটি বাঘকে নদীর এপার থেকে ওপার যেতে দেখেছেন অনেকেই। কেউ কেউ এটি ক্যামেরাবন্দি করে রেখেছেন।

সুন্দরবনের জেলে, কাঁকড়া শিকারী, মৌয়াল এদের বেশির ভাগই বিনা অনুমতিতে ও কোনো প্রকার আত্মরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া বনে প্রবেশ করে। আর এরা বাঘের জন্য বেশ সহজ শিকার। সহজে শিকার করা যায় বলেই মাঝেমধ্যে এ বাঘগুলো মানুষের ঘাড় মটকায়। কিন্তু গুজব আর মিথ ছাড়া সুন্দরবনকে চিন্তা করা যায় না। এসব চিন্তা করতে করতেই রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সকালে জাহাজের তিন তলায় উঠতেই দেখা হলো জাহাজের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘুম হয়নি মনে হচ্ছে। বাঘের স্বপ্ন দেখলেন নাকি রাতে? ভয় পাবেন না। ও আমি প্রতি রাতে দেখি। ছোটবেলায় বাঘ মামা আর শিয়াল পণ্ডিতের গল্প শোনেননি, এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। কিংবা, ‘বনের রাজা কে? বাঘ নাকি সিংহ?’, এই ধাঁধার মাঝে পড়েননি, এমন মানুষের সংখ্যাও হাতেগোনা। সিংহকে বনের রাজা বলা হলেও বাস্তবে সিংহ কিন্তু বনে বাস করে না। পৃথিবীর বেশির ভাগ সিংহের বসবাস আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির সাভানা অঞ্চলে। অন্যদিকে, বাঘের বসবাস কিন্তু এশিয়ার মাত্র কয়েকটি দেশের বন-জঙ্গলে। বাংলাদেশ ও ভারতের কোল ঘেঁষা সুন্দরবন এই বাঘের অন্যতম প্রধান বিচরণক্ষেত্র। একসময় পৃথিবীতে বাঘের নয়টি উপ-প্রজাতি ছিল। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড়শ’ বা দুইশ’ বছর আগে তিনটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং পৃথিবীতে এখন টিকে রয়েছে মাত্র ছয়টি উপ-প্রজাতির বাঘ। তবে আকৃতি এবং সৌন্দর্য্যে যেসব বাঘ খ্যাতিমান, তার মধ্যে সুন্দরবনের বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগার অন্যতম।

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

বাঘের ইচ্ছে হলেই সম্ভব

আপডেট সময়: ১১:৫৫:৫৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ এপ্রিল ২০২৫
শামীমুল হক

বাঘের সঙ্গে মোলাকাত ক’জনের হয়েছে? সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখাই কি শেষ কথা? খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জুড়ে সুন্দরবনের বিস্তৃতি। এটা শুধু বাংলাদেশ অংশ। ভারতের অংশেও রয়েছে সুন্দরবনের একাংশ। দুই দেশ মিলে দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠেছে এই সুন্দরবন। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছয় হাজার সতের বর্গ কিলোমিটার। মোট কথা সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে। বাকিটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। আমরা যখন খুলনা থেকে জাহাজে উঠি রাত তখন প্রায় তিনটা। প্রত্যেকেই যার যার কেবিনের চাবি বুঝে নিয়ে রুমে চলে যাই। প্রত্যেক রুমে রয়েছে স্পিকার। হঠাৎ স্পিকারে বলতে শোনা যায়Ñ সকাল আটটায় নাস্তার পর সুন্দরবন নিয়ে একটা ধারণা দেয়া হবে। সবাইকে যথাসময়ে জাহাজের তিন তলায় খাবারের রুমে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানান ঘোষক। জাহাজ চলছে নদীর মাঝ দিয়ে। দু’পাশে সুন্দরবন। এমন অপরূপ দৃশ্য? কোনো মানুষের পক্ষে কি এভাবে সাজানো সম্ভব? আসলে প্রকৃতির এমন উপহার মানুষের জন্য। তাই তো দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ ছুটে চলে সুন্দরবন দেখতে। বাঘের দেখা পেতে। কিন্তু বাঘের দেখা পাওয়া আর পাহাড় ঠেলা সমান কথা। কারণ যেদিকে বাঘ থাকে সেদিকে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয় না। এটা অঘোষিত একটা নিয়ম। তিন দিনের সুন্দরবন সফরে এমনটাই মনে হলো। আর সকালে গাইড আল-আমিনের কথায় এটা আরও স্পষ্ট হলো। নাস্তা পর্ব শেষে সবাই যার যার টেবিলে বসা। জাহাজ চলছে বিরতিহীনভাবে। গাইড আল-আমিন এসে দাঁড়ালেন একটি টিভির সামনে। গুডমর্নিং সবাইকে। আমি গাইড আল-আমিন। তিনদিন আপনাদের সঙ্গে থাকবো। সুন্দরবনের রহস্য কথায় এগিয়ে যাবো সামনে। এই যে সুন্দরবন এটা বাঘের অভয়ারণ্য। আর সুন্দরবনের বাঘ পৃথিবীর সকল বাঘের চেয়ে আলাদা। আমি প্রায় নয় বছর ধরে গাইড হিসেবে সুন্দরবনে রয়েছি। এই যে জাহাজ এটি একেবারেই নতুন। পাঁচ মাস হলো নামানো হয়েছে। এখন এখানে আছি। বহু পর্যটকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আলাপ হয়েছে। বন্ধুত্ব হয়েছে। কিন্তু এই নয় বছরে আমি কোনো বাঘ দেখতে পাইনি। তাই বলে আপনারা হতাশ হবেন না। ভাগ্য ভালো থাকলে একদিনেই আপনারা বাঘ দেখতে পাবেন। এমনটা হয়েছে শুনেছি। আল-আমিনের কথায় বুঝা গেল বাঘ দেখাটা আসলে দুরূহ। কারণ যেদিকে বাঘ থাকে সেদিকে পর্যটকদের নিয়েই যাওয়া মানা।

আল-আমিন স্পষ্ট করে না বললেও আন্দাজ করা যায়। সুন্দরবনের হরিণের কথাও বললেন তিনি। পাখ-পাখালির কথাও বাদ যায়নি। টিভি স্ক্রিনে ভেসে ওঠলো  মানচিত্র। আমরা কোন কোন নদী দিয়ে কোথায় যাবো। এমন সময় আল-আমিন জানালেন আগামীকাল আমরা কটকায় যাবো। তবে আপনাদের জন্য সুখবর হলো কটকায় হেঁটে যেতে পারবেন। যেখানে জাহাজ থামবে সেখান থেকে সাড়ে ৯ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হবে। আর যারা যাবেন না তারা জাহাজেই থাকবেন। জাহাজও একই সঙ্গে ছাড়বে। এই সাড়ে ৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জাহাজ গিয়ে থামবে। ওদিকে যারা হেঁটে যাবেন তারাও সেখানে গিয়ে একসঙ্গে মিলিত হবেন। হেঁটে যাওয়া পথের তিন কিলোমিটার জঙ্গল। তিন কিলোমিটার বিস্তীর্ণ চর। আর তিন কিলোমিটার সাগর। অন্যরকম এক ফিলিংস এই হেঁটে যাওয়ার। যারা গিয়েছেন তারা বলেছেন, এমন স্মৃতি মনের গহীনে গেঁথে থাকবে আজীবন। যারা যাননি তারা বড্ড মিস করেছেন। গাইড আল-আমিন বলেই যাচ্ছিলেন সুন্দরবনের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা। এই তিনদিন আমরা কোথায় কোথায় যাবো। কীভাবে যাবো। সবই বলা হলো। পরদিন ভোর ৬টায় পাখি দেখতে যারা যাবেন তাদের কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। কি করতে হবে সবই বললেন। কুমির প্রজনন কেন্দ্রে গিয়ে কি করতে হবে। কীভাবে চলতে হবে। আল-আমিনের সব মুখস্থ। সবশেষে বললেন, এরপরও যদি কারও কিছু জানার থাকে আমাকে বলবেন। আমি সর্বদা আপনাদের সেবায় নিয়োজিত।  কথায় কথায় জাহাজ গিয়ে থামলো হাড়বাড়িয়া পয়েন্টে। এবার আল-আমিন বললেন, এবার আমরা হাড়বাড়িয়া পয়েন্টে যাবো। ঘুরে দেখবেন জীব বৈচিত্র্য। খুলনা চার নম্বর ঘাট থেকে যে ট্রলারে করে আমরা দূরে অপেক্ষারত জাহাজে গিয়ে উঠেছিলাম সেই ট্রলার আর জাহাজ ছাড়েনি। ট্রলার বেঁধে দেয়া হয় জাহাজের সঙ্গে। যেখানেই যাই জাহাজ মাঝ নদীতে থেমে যায়। তারপর ট্রলার নিয়ে যায় তীরে বা কোনো স্পটে। আমরাও এবার জাহাজ থেকে নেমে ট্রলারে গিয়ে বসলাম। উদ্দেশ্য হাড়বাড়িয়া পয়েন্ট দেখা। চার কিংবা পাঁচ মিনিট চলার পরেই হাড়বাড়িয়া পয়েন্ট। ট্রলার থেকে একে একে সবাই নামলাম। প্রবেশ পথেই বানরের দেখা। দলবদ্ধ বানরের দল। এত মানুষ দেখেও বানরগুলোর কোনো ভয় নেই। বরং আমাদের এক সহযাত্রীকে আক্রমণ করে বসে। গাইড আগে এগুচ্ছে আমরা পেছনে পেছনে। যতই এগুচ্ছি সামনে গহীন জঙ্গল। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে বাঘ দেখা যায় কিনা? ভয়ও কাজ করছে সবার মনে এই বুঝি বাঘ হামলে পড়ছে কারও না কারও ওপর। ভয় আর আতঙ্কে হিমশীতল হয়ে আসছিল শরীর। অন্যদিকে সুন্দরবন দেখার আনন্দও ছিল মনে। মাঝে মাঝে গাইড চিৎকার করে বলছিলেন সবাই  একসঙ্গে থাকেন। কেউ একা হবেন না। তাহলে বিপদ হতে পারে। হাড়বাড়িয়া পয়েন্টটি খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দুই কিলোমিটার জঙ্গলের ভেতরে গিয়েও বাঘের দেখা পাওয়া যায়নি। যা দেখা গেছে তা হলো বাঘের পায়ের ছাপ। আর ছাপ কোথায়? যে পথে মানুষ চলাচলের জন্য সুন্দর করে ইটপাথরের সুড়কি দিয়ে বানানো হয়েছে তার পাশেই। মানুষ যেন চলাচল করতে পারে সেজন্য এ পথ বানানো হয়েছে উঁচু করে পিলারের উপর। দুই পাশে আবার রেলিং দেয়া।

হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ পর পর দেখা যাচ্ছিল বাঘের পায়ের ছাপ। আসলেই কি এটা বাঘের পায়ের ছাপ? এখানেও রয়েছে রহস্য। কথিত রয়েছে, বন বিভাগ থেকে এক ধরনের অস্ত্রের মাধ্যমে এমন ছাপ দেয়া হয়। পর্যটকরা যাতে পায়ের ছাপ দেখে শিহরিত হন। বাঘ না দেখলেও পায়ের ছাপ দেখেছি-এটা ভেবে তৃপ্তি পান। এমন তৃপ্তি নিয়েই হাজার হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসেন নিজ গন্তব্যে। বেশক’টি নদী ঘিরে রেখেছে সুন্দরবনকে। এর সবক’টিই জোয়ার- ভাটার নদী। তাই জোয়ারে সুন্দরবনে পানি জমে। আবার ভাটায় সেই পানি নেমে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে জোয়ারের পানিতে যেন গাছ না মরে এ প্রতিটি গাছই তাকে রক্ষায় শ্বাসমূল ছড়িয়ে দেয়। ছোট থেকে বড় বহু শ্বাসমূল ঘিরে রাখে প্রতিটি গাছকে। গাইড আল-আমিন সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলটি দেখিয়ে বলেন, এটি সবচেয়ে বড়। মানে হলো জোয়ারে পানি এ শ্বাসমূলের উপরে উঠে না। জোয়ারের সময় গাছ এ শ্বাসমূল থেকে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে। হাড়বাড়িয়া পয়েন্টেই ছোট খালে এক প্রকার মাছ দেখা যায়। এ মাছগুলোর সামনে গিয়ে গাইড আল-আমিন এ মাছের বিশদ বর্ণনা দেন আমাদের। এ মাছ জলে ও স্থলে বসবাস করে। সামনেই একটি পুকুর। পুকুরে পানি থৈ থৈ। নিশ্চয় জোয়ার- ভাটায় এ পুকুরও ডুবে ও ভাসে।

সুন্দরবন নাম হয়েছে সুন্দরী গাছের কারণে। কিন্তু সুন্দরী গাছ কীভাবে সুন্দর তা বোঝা গেল না। তবে তার একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সুন্দরী গাছের গোড়া এমনভাবে নিজ থেকে তৈরি যা দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। গাছটিকে যেন চারদিক থেকে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। যেন ভেঙে না যায়। কারণ সুন্দরী গাছ একেবারে লম্বা ও সোজা হয়। এর কোনো ডালপালা নেই। একেবারে লক-লকিয়ে এগিয়ে গেছে উপরে। প্রচণ্ড বাতাসেও এ গাছ ভেঙে পড়ে না। কারণ তার গোড়ায় নিজ থেকেই মোটা মোটা জড় ঠেস দিয়ে রেখেছে। আসলেই প্রকৃতির কী খেলা! প্রত্যেকেই নিজেকে বাঁচানোর উপায় নিজেই খুঁজে নেয়। সুন্দরী গাছও তেমন। আর এ সুন্দরী গাছ বেশি দেখা যায় আন্দারমানিক পয়েন্টে। হাড়বাড়িয়া ভ্রমণ শেষে আন্দারমানিকের উদ্দেশ্যে যাত্রা। শুরুতেই বাঘের ছবি দিয়ে বিরাট নিয়ন সাইনের পোস্টার সাঁটানো। এ বাঘ দেখেই আন্দারমানিক স্পটে প্রবেশ। শুরুতেই বিশাল এক উঁচু টাওয়ার। এর নাম ডলফিন টাওয়ার। এ টাওয়ার থেকে নদীতে ডলফিন দেখা যায় বলে এর নাম রাখা হয়েছে ডলফিন টাওয়ার। সহযাত্রীদের অনেকেই ডলফিন দেখতে এ টাওয়ারে উঠেন। তাদের দু’চোখ নদীর দিকে বড় বড়  চোখ নিয়ে তাকানো। ডলফিন দেখার স্বপ্ন এ চোখে। কিছুক্ষণ পর একে একে সবাই নেমে এলেন। কি ভাই ডলফিন দেখেছেন। কেউ কোনো কথা বলছে না। অবশ্য গাইড আল-আমিন কথার মারপ্যাঁচ জানেন ভালো। আগেই বলে নিয়েছিলেন ডলফিন টাওয়ারে উঠলে ডলফিন দেখা যেতেও পারে। নাও পারে। যাদের ভাগ্য ভালো তারা ডলফিন দেখতে পায়। এই আন্দারমানিকে বেশক’টি হরিণ আটকে রাখা হয়েছে। বাউন্ডারির বাইরে থেকে ডাক দিলে হরিণগুলো ছুটে আসে। কেউ কেউ এসব হরিণকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অবশ্য জাহাজ চলাকালীন সুন্দরবন থেকে অনেক হরিণ নদীতে পানি খেতে এসেছে তা দেখা গেছে। আন্দারমানিকের প্রায় দেড় কিলোমিটার  ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে সব সুন্দরী গাছের আখড়া।

এবার পশু-পাখি দেখার পালা। জাহাজ এক জায়গায় গিয়ে থামলো। সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো সকাল ৬টায় ট্রলার পশু-পাখি দেখার জন্য যাবে। যথাসময়ে সবাই ট্রলারে গিয়ে উঠলেন। ট্রলার ছাড়লো। একটু সামনে গিয়ে মূল নদীর শাখা দিয়ে প্রবেশ করলো ট্রলার। একটি খালের মতো। সবার নজর খালের দু’পাশের গাছের দিকে। পাখি দেখার জন্য। কিন্তু না! কোনো পাখিই দেখা যাচ্ছিল না। কিছু দূর যাওয়ার পর একজন এসে বললেন, ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে দাও। আস্তে আস্তে চলুক। ইঞ্জিনের শব্দে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। সত্যিই তাই। ইঞ্জিন বন্ধ করে ট্রলার এগুতে থাকে। এবার পাখির কিচিরমিচির শব্দ কানে আসছে। আসছে বন মোরগের ডাক। সত্যিই পাখ-পাখালির এমন ডাক মন ছুঁয়ে যায়। কিন্তু খালের পাশের কোনো গাছেই পাখির চিহ্নটি পর্যন্ত নেই। ফেরার পথে আবার একই দৃশ্য। চোখ বড় করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই। কিন্তু না পাখির দেখা মিললো না। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর বন মোরগের ডাক পুঁজি করেই ফিরে আসা জাহাজে। সেখান থেকে করমজাল যাওয়া। যেখানে রয়েছে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সেখানে গিয়ে দেখা মিললো ছোট ছোট দোকানপাটের। দোকানিরা এসেছেন মোংলা থেকে। করমজালে আসা পর্যটকদের কাছে তাদের পণ্য বেচতে। পণ্য বলতে পানি, চা, রুটি, পেয়ারা, শসা, পানীয়। কিন্তু সবই ডাবল দাম। আবার সেখানে হরিণের খাবার বিক্রি হচ্ছে। মানুষ লাইন ধরে খাবার কিনছে। হরিণকে খাবার দিবে বলে। করমজালে হরিণ, বানর সবই আছে। তবে কুমির দেখতেই এখানে ভিড় বেশি। করমজালের নদীতেও কুমিরের আস্তানা। করমজালের ভেতরে একটি পুকুর আছে। এ পুকুরেই প্রথম আনা হয় রোমিও আর জুলিয়েট কুমির জুটিকে। কিন্তু রোমিও আর জুলিয়েট প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে জুলিয়েটকে বন্দি করে রাখা হয় একটি খাঁচায়। আর রোমিওকে নদীতে ছেড়ে দেয়া হয়। রোমিও যেন তার আর কোনো সঙ্গীকে বেছে নিতে পারে। কিংবা সে তার পথ নিজেই বেছে নিবে। বেশক’টি খাঁচায় ছোট কুমির আর বড় কুমির। পুকুরের পাড়ে গিয়ে দেখা গেল বড় দুটি কুমির পানি থেকে পাড়ে উঠে ঘুমিয়ে আছে। একটি উল্টো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। প্রথম দেখায় মনে হয়েছে মরে আছে। এত মানুষের হইচই তবু কুমিরের ঘুম ভাঙছে না। মনে মনে ভাবলাম এ জন্যই বুঝি বলা হয়, কুমিরের ঘুম ঘুমিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর একটি কুমির সজাগ হয়ে দ্রুত পুকুরে নেমে যায়। অন্যটি মরার মতো ঘুমিয়েই আছে। ফেরার পথে সেখানকার ডাব খেয়ে একে একে সবাই ট্রলারে উঠেন। এরপর ট্রলার নিয়ে যায় আমাদের জাহাজে।

সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে হলেও এ অংশে নাকি বাঘ আছে ১২৫ কি ১২৮টি। আর ভারতের অংশে ৪০ শতাংশ হলেও সেখানে বাঘ রয়েছে ৪০০-এর উপরে। আচ্ছা বাঘ কীভাবে গণনা করে। এ নিয়ে মনে প্রশ্ন। শুধু আমার নয়, অনেকের মনেই এ প্রশ্ন। আর বাঘের সংখ্যা যে বলা হয় এটা কতোটুকু সত্যি? এ নিয়ে অনেক কিছু লেখা যায়। তবে লিখলে বাঘ গণনায় যে বাজেট তাতে টান পড়বে। তারচেয়ে বরং যে হিসাব দেয়া হয় সেটা মেনেই সবার চলা উচিত। চলছেও।  সুন্দরবন পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন যেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাস করে। কিন্তু এ বনে বাঘের দেখা মেলা অন্য যেকোনো বনের চেয়ে বেশ দুরূহ। সুন্দরবনে দিনে দু’বার জোয়ার-ভাটা হয়। এখানে মোটরবোটে চড়ে বন দেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তবে প্রায়ই রিপোর্ট হয় কোনো না কোনো সময়ে জেলে, কাঁকড়া শিকারী, মধু আহরণকারী ও গোলপাতা আহরণকারীরা বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন।
সুন্দরবনে কথা হয় এক গোলপাতা আহরণকারীর সঙ্গে। তাকে বাঘের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ওই যে বাঘের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে একটা বাঘ এখান দিয়ে গেছে। কথায় কথায় তিনি বলেন, বাঘ দেখবেন কোথা থেকে? বাঘের নির্দিষ্ট একটি এলাকা আছে।  সে এলাকায় আপনারা যেতে পারবেন না। তবে একটা কথা শুনে রাখুন সুন্দরবনে কেবল বাঘের ইচ্ছে হলেই মানুষ তাকে দেখতে পায়। করমজালে কথা হয় মামুনের সঙ্গে। তার বাড়ি মোংলায়। প্রতিদিন নদী পার হয়ে করমজালে আসে। পেয়ারা-শসা আর বড়ই বিক্রি করছে এখন। বেশির ভাগ সময় মৌসুমি ফলমূলই বিক্রি করে। মামুনের কথাÑ সুন্দরবনের আনাচকানাচ তার নখদর্পণে। তার মতো এখানকার বাসিন্দাদের কাছে বাঘ হচ্ছে ‘মামা’। সকালে বেরুনোর আগে বনবিবির কাছে প্রার্থনা করে বেরিয়েছে মামুন।  সুন্দরবনের নরম মাটিতে বাঘের পায়ের চিহ্ন কয়েক ইঞ্চি ডুবে আছে। যেন কিছুক্ষণ আগে কেওড়ার শ্বাসমূল বাঁচিয়ে নেমে এসেছিল বাঘ। হাড়বাড়িয়া পয়েন্টের একজন কর্মচারী ফ্যাকাসে মুখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো। ‘মানুষখেকো, বেজায় চালাক। গত সপ্তাহে এক জেলের ওপর হামলা চালিয়েছিল। বেচারা ছুরি দিয়ে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বাঘটিই তার দফারফা করে ফেলে। তার কথা কানে আসতেই আমি ঢোক গিললাম। আগেই বলেছি দিনের মধ্যে দু’বার সুন্দরবন পানির নিচে ডুবে যায়। এখানকার বাঘদের তখন লবণাক্ত পানি পান ও আধা-জলজ জীবনযাপন করতে হয়। এ কারণে সুন্দরবনের বাঘ দক্ষ সাঁতারুও। এ বনের বাঘের লেজ শক্ত ও পেশিবহুল। সাঁতারের সময় পানিতে লেজ ঝাপটায় এটি। সুন্দরবনের বাঘ অন্য জায়গার বেঙ্গল টাইগারের মতো নয়। এর খাদ্যাভ্যাসও অন্যদের থেকে ভিন্ন। এ বনের বাঘেরা মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ, বড় গুঁইসাপ ইত্যাদিও শিকার করে। সুন্দরবনের বাঘের সাপ শিকার করারও নজির আছে। তবে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। ক’দিন আগে একটি বাঘকে নদীর এপার থেকে ওপার যেতে দেখেছেন অনেকেই। কেউ কেউ এটি ক্যামেরাবন্দি করে রেখেছেন।

সুন্দরবনের জেলে, কাঁকড়া শিকারী, মৌয়াল এদের বেশির ভাগই বিনা অনুমতিতে ও কোনো প্রকার আত্মরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া বনে প্রবেশ করে। আর এরা বাঘের জন্য বেশ সহজ শিকার। সহজে শিকার করা যায় বলেই মাঝেমধ্যে এ বাঘগুলো মানুষের ঘাড় মটকায়। কিন্তু গুজব আর মিথ ছাড়া সুন্দরবনকে চিন্তা করা যায় না। এসব চিন্তা করতে করতেই রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সকালে জাহাজের তিন তলায় উঠতেই দেখা হলো জাহাজের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘুম হয়নি মনে হচ্ছে। বাঘের স্বপ্ন দেখলেন নাকি রাতে? ভয় পাবেন না। ও আমি প্রতি রাতে দেখি। ছোটবেলায় বাঘ মামা আর শিয়াল পণ্ডিতের গল্প শোনেননি, এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। কিংবা, ‘বনের রাজা কে? বাঘ নাকি সিংহ?’, এই ধাঁধার মাঝে পড়েননি, এমন মানুষের সংখ্যাও হাতেগোনা। সিংহকে বনের রাজা বলা হলেও বাস্তবে সিংহ কিন্তু বনে বাস করে না। পৃথিবীর বেশির ভাগ সিংহের বসবাস আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির সাভানা অঞ্চলে। অন্যদিকে, বাঘের বসবাস কিন্তু এশিয়ার মাত্র কয়েকটি দেশের বন-জঙ্গলে। বাংলাদেশ ও ভারতের কোল ঘেঁষা সুন্দরবন এই বাঘের অন্যতম প্রধান বিচরণক্ষেত্র। একসময় পৃথিবীতে বাঘের নয়টি উপ-প্রজাতি ছিল। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড়শ’ বা দুইশ’ বছর আগে তিনটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং পৃথিবীতে এখন টিকে রয়েছে মাত্র ছয়টি উপ-প্রজাতির বাঘ। তবে আকৃতি এবং সৌন্দর্য্যে যেসব বাঘ খ্যাতিমান, তার মধ্যে সুন্দরবনের বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগার অন্যতম।