॥ ছোটগল্প ॥
নীলক্ষেত মোড়ে
আতোয়ার রহমান
ঝাঁঝালো রোদের এক আশ্চর্য বসন্তের দিন। গাছে পলাশ শিমুলের হলুদ-লাল রঙের ফোটা ফুলের মেলা বসেছে। তার ভেতর থেকে ভেসে আসছে কোকিলের কুহতান। বসন্তের রোদ এসে পড়ছে ইট সিমেন্টের বাঁধানো ফুটপাথে। রৌদ্রস্নাত স্নিগ্ধ শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে বসন্তের বাতাস। ধীরে ধীরে নীলক্ষেত মোড়ের রাস্তার ধারের ফুটপাথে ও লাগোয়া চত্বরে ভিড় বাড়ছে। চারপাশে কোলাহল, গাড়ির গোলমাল, রিকশার ক্রিং ক্রিং। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ; কবিতাবই। সকলেই হাঁটছে; ফুটপাতে; বিশ টাকার বইয়ের দোকানে; জিলাপির আর তিহারির ঘ্রাণ, নতুন পুরোনো বইয়ের ঘ্রাণ পাশ কেটে―সময় আটকে গেছে নীলক্ষেত মোড়ে, ঢাকার বইয়ের আড়তে। চন্দ্রগ্রস্ত যৌবন থেমে গেছে ফুটপাতে, মহুয়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। গাড়ি, রিকশা, বাস ট্রাফিক জ্যাম, ধুলো এবং তাপে রাস্তায় আগে যাওয়ার জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করছে ... রাস্তায় বাংলাদেশের সতের কোটির প্রতিফলন।
পুরানা বইয়ের লোভ বইপোকা সৈকতকে ছেড়ে যায়নি, তাই সারি সারি বইয়ের নিচে তার নিঃসঙ্গতা চাপা দেওয়া আর পুরনো বই জোগাড় করে ইতিহাস, সমাজ, দর্শন, রাজনীতি আর সাহিত্যের ঘুপচিগলি জানার জন্য স্যাঁতসেঁতে ঘুপচিগলি আর ভিড়ে ঠাসা পথ পার হয়ে মাঝে মাঝে পুস্তক রসিকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য পুরোনো বইয়ের আস্তানা নীলক্ষেতে চলে আসে সৈকত। আজও এসেছে। সৈকত খুব ধীরেলয়ে হাঁটে। প্রত্যেকটা দোকানের নাম পড়তে পড়তে সামনে আগায়। ফ্রেন্ড’স বুক কর্নার, ‘সুমি টিস্টল’...। সারি সারি বইয়ের আর ফটোকপির দোকান ! ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই বই। দোকানের ভেতরে বিক্রেতার মুখ ঝলমল করা হাসি। অনলাইনে বই কেনা-পড়ার জোয়ার আসার পরেও এখানে পাঠকদের প্রচুর ভিড়। ক্রেতাদের গা ঘেঁষা ভিড় ঠেলে সে একটা পুরনো বই খুঁজছে, কিন্তু কোনো দোকানে সেটা পেলনা। তখনই পরিচিত এক দোকানদার লোভ দেখিয়ে তার দোকানে নিয়ে গেলেন। প্রতিবারই এটা হয়, ডাকাডাকি পড়ে যায়। শুরু করলেন জা পল সাত্র’র ‘ওয়ার্ডস’ দিয়ে, তারপর থরে থরে সাজানো পুরোনো বইয়ের বান্ডিল থেকে ধুলো ঝেড়ে বের করলেন রাখাল বন্ধোপধ্যায়ের ভারতবর্ষের ইতিহাস এবং ‘অনুস্বর’ নামে একটি চটি ম্যাগাজিন। মোট তিনটি অমুল্য বই ঝোলায় ভরলো মাত্র দুইশ টাকা মুল্যে। সৈকতের কাছে মনে হল বইতো নয় কিছু মুল্যবান রত্ন বা গুপ্তধন কিনলেন! এখন তার কল্পলোকে পৌঁছে যাওয়ার পালা।
“আপনি কেমনে বুঝলেন এই বইগুলো আমি কিনব?” সৈকত জিজ্ঞাসা করলে দোকানদার সহাস্য বদনে বললেন,
“আপনি নিতে পারেন বলেই এগুলো বের করলাম, সকলে তো আর এসব বইয়ের মর্ম বোঝে না। আমি সবসময়ই পাঠকের স্বাদ বুঝে চলি। এতদিনের যোগাযোগে জেনে গিয়েছি কোন বই কাকে দিতে হবে। একটা বই হাতে নিলে আমি বুঝতে পারি, সেই বইয়ের সম্ভাব্য পাঠক কারা। আমরা লোক চিনতে ভুল করিনা। এত বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।“
“আজকাল আপনার বেচা বিক্রি কেমন চলছে?”
“এখন তো তেমন খরিদ্দার পাই না। তবে এসব পুরোনো বইয়ের মর্যাদা আলাদা। যারা জানে তারা ঠিক নিয়ে যায়। তাদের সংখ্যাও কমেছে। এভাবেই চলছে।“
সৈকত সোভিয়েতের রাজনীতি-দর্শন-সাহিত্য বিষয়ে যে বইটা খুঁজছিল সেটা সে কোনো দোকানে পেলনা। সে এবার ঘুপচিগলি থেকে বের হয়ে ফুটপাথে চলে এল। নীলক্ষেতের ফুটপাথ। পলিথিন পেতে বই বিক্রি করছেন অনেকে। হ্যামিলনের বাসি বাজিয়ের মতো প্রাক-ইন্টারনেট যুগের ঢাকার রোমান্টিসিজম ধরে রেখেছেন ফুটপাথের পলিথিন বিছানো এই বই বিক্রেতারা। একটি দোকানের সামনে গিয়ে উপুড় হয়ে বই খুঁজছেন সৈকত। হলুদ রঙের বাসন্তি শাড়ি পড়া এক তরুণী। চোখে হালফ্যাশনের বেগুনি কাচের রোদচশমা। চেহারাটা তন্বী। ফর্সা গালে ঠোঁটের পাশে একটা ছোট্ট তিল, যাকে বলে একদম বিউটি স্পট। ফুটপাথ দিয়ে দু’পাশে কী যেন খুঁজতে-খুঁজতে চলেছেন। হয়তো তিনিও তার মতো কোন বই খুঁজছেন। অবশ্য এই শেষ দুপুরে এমন অনেক সুন্দরী তরুণীকে এ চত্বরে বই ও সাংসারিক জিনিসপত্র খুঁজতে দেখাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। আশ্চর্যের যেটা হল, এ দিক-ও দিক দেখতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর হাতটা ফুটপাতের এক পাশে শরীরটা নিচের দিকে ঝুঁকে বই খুঁজতে থাকা সৈকতের হাত ছুঁয়ে গেল।
আর সঙ্গে-সঙ্গেই সৈকত রেগে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, “কী হলটা কী?”
তরুণীটিও চমকে উঠে বললেন, “স্যরি, স্যরি। অত্যন্ত দুঃখিত,” বলে সানগ্লাসটা কপালের উপরে তুলে খানিক অবাক হয়ে তাকাল সৈকতের দিকে। পারুল হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল, “আরে! সৈকত না?”
পারুল ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে এ কী দেখল! হুম, সৈকতই তো…
সৈকত এ বার হকচকিয়ে গেল, “না, মানে হ্যাঁ, তো।”
সৈকত উঠে দাড়াল, এগিয়ে গেল-একি পারুল তুমি?
আমি মনে করেছিলাম আমার শরীর ছুঁয়ে কোন পথশিশু হয়তো টাকা চাচ্ছে। শাড়ি পরা অবস্থায় তোমাকে কখনো আগে দেখিনি। তোমাকে শুধু নীল শাদা সেলওয়ার কামিজ বা ফ্রক পরা দেখেছি। তাই এত দিন পরে চিনতে কষ্ট হলো।
হ্যাঁ, প্রথম দেখায় আমিও পারিনি তোমাকে চিনতে।
পারুলকে দেখে সৈকতের ইতস্ততার কারন তার স্কুল জীবনের একটি ঘটনা।
দুজনে ছোটবেলার বন্ধু। টাঙ্গাইলে একই স্কুলে পড়াশোনা করতো তারা। সৈকত পড়তো ক্লাস টেনে। পারুল তখন ক্লাস নাইনে। কিশোর মনের চঞ্চলতা, ভীরুতা নিয়েই হয়েছিল সম্পর্কের শুরু। খুব আস্তে আস্তে কথা বলত পারুল। সৈকত যতটা ছটফটে, পারুল ততটাই ধীরস্থির। কী ভাবে যে বিপরীত চরিত্রের দু’জনের এমন বন্ধুত্ব গড়ে উঠল, স্বয়ং উপরওয়ালাই জানেন। দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্টতা থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। গোপনে চিঠি দিতো। পারুলের গায়ের রং শ্যামলা ছিল, কিন্তু ওর চোখ দুটোতে ছিল গভীর মায়া। ঘন আঁখিপল্লবে ঢাকা চোখ দুটোর দিকে তাকালে সৈকতের মনে হত শান্ত ছায়াঘন এক নিস্তরঙ্গ দিঘি। পারুলের সঙ্গে দেখা করতে বা তাকে এক নজর দেখার জন্য মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় নাগর নদী পার হতো নৌকায় করে। যদি একবার চোখাচুখি হয়ে যায় তাহলে একটা মুচকি হাসি বুক পকেটে নিয়ে বাড়ি ফেরা। এতই সহজ সরল প্রেম ছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু পারুলের সঙ্গে সৈকতের সম্পর্কের সুতো বোনা শুরু হতে না হতেই ঝামেলা শুরু হয়।
একটা সময় আড়ালে আবডালে লুকিয়ে চলছিল প্রেম। তবে কিছুদিন পরে যেন সাহসী হয়ে উঠেন দু’জনই। মফস্বল শহর টাঙ্গাইলের গায়ে তখন একটু একটু করে আধুনিকতার ছোঁয়াচ লাগছে। তা সত্ত্বেও সে সময়ে লুকিয়ে প্রেম করা ছিল চরম অপরাধ। প্রেমের পথে তখন নানা বাধা। বংশ, বিত্ত, স্টেটাস কত রকমের বাধা যে পেরোতে হত, তার হিসেব নেই। সেই বৈরি আবহাওয়ার ভিতরে হঠাৎ খবরের শিরোনামে উঠে এল তারা, সবাই জানল চৌধুরীবাড়ির মেয়ে পারুলের সঙ্গে সোনালি ব্যাংকের কেরানির ছেলে সৈকতের, প্রেম চলছে। সেই সংক্রান্ত রসালো আলোচনা ছড়িয়ে পড়ল প্রায় সমস্ত চেনাজানা মহলেই। ছোট জায়গা, আলোচনার মুখ অনেক, কিন্তু উপযুক্ত রসালো খবরের সংখ্যা তুলনায় কম, ফলে যা হয়! সমাজ তাদের কিশোর প্রেমকে দুচ্ছাই করতে লাগল।
মেঘের পরে মেঘ জমেছে বুঝতে পারেনি তারা। পারুলের বাড়ি থেকে চাপ নেমে এল সম্পর্কটা আর এগিয়ে না নেওয়ার। পারুলের কঠোর বাবার মেয়ের উপরে অধিকারবোধ প্রবল। প্রেম দূরের কথা, কোনও ছেলে তাঁর মেয়ের হাত ধরবে! স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। আর পারুলও বাবাকে যমের মতো ভয় পায়। বাবার কড়া শাসনে বেড়ে ওঠা পারুল ভীষণ লাজুক, শান্ত। বাবার ভয়ে কিছুতেই আর সৈকতের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে না। আবার বিভিন্নমুখী চাপের কারণে সৈকতের বাবাও হঠাৎ বদলি হয়ে ঢাকা চলে আসেন। ফলে সৈকত আর পারুলের এই সহজ সরল সম্পর্কটা উধাও হয়ে যায়। তা আর স্থায়ী সম্পর্কের দিকে এগোয়নি। সৈকত পারুলকে কিছু না বলেই বাবা মায়ের সাথে ঢাকা চলে আসে, মিরপুরের একটি স্কুলে ভর্তি হয়। কোন কিছু না বলে সৈকতের এভাবে হারিয়ে যাওয়ায় পারুল ভীষণ কষ্ট পায়। ঘটনার আকস্মিকতায় ছটফটে ও সদা চঞ্চল সৈকত হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ থাকার পর সৈকত বলল,
'পারুল, আমরা কোথাও বসি চলো। একটা ক্যাফেতে বসে কথা বলি, গলা একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে। একটু কফি খাই।‘
‘চল, ঐ দিকে একটা ক্যাফে আছে, বেশ নিরিবিলি, ওদের চা কফিও ভাল, কম্পারেটিভলি ইনএক্সপেনসিভ। আই মিন পকেট-ফ্রেন্ডলি!”’-পারুল সৈকতকে হাত ইশারা করে বলল।
কথায় লুকনো ছোবলটা বুঝতে পারে সৈকত। আহত চোখদুটো নামিয়ে নেয়। তার পর ওরা দু’জনে বসে কফিশপে। দু’কাপ কফি আর স্যান্ডউইচের অর্ডার দিয়ে ফিরে এসে দিনের বেলায় আলো-আঁধারিতে ভরা ক্যাফের কাঠের চেয়ারে তারা মুখোমুখি বসল। সৈকতের চশমা পরা চোখদুটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন পারুল। ঈষৎ পাক ধরা চুল, চোখ মুখ অল্প ফুলেছে, ঠোঁটের কোনায় কমদামি সিগারেট। ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে, কিন্তু তাও কল কল করে ঘাম ঝরছে সৈকতের সারা শরীরে। চেয়ারটা আরও কাছে টেনে এনে পারুল সৈকতকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। দেখে হারানোর বেদনা, অতীতের স্মৃতি। সৈকত লক্ষ্য করল পারুলের দু’কূল ছাপিয়ে পাহাড়ি নদীর মতো বইতে শুরু করেছে প্রগাঢ় অভিমান।
সৈকত পারুলের চোখে দেখে ঘন ছায়া, সেদিকে তাকিয়ে বলে,
-ভালো আছো পারুল? অনেক দিন পর দেখা। আমি শুনেছি তুমি নাকি বিয়েশাদি করেছো?
পারুলের ঠোঁটের কাছে যেন নেমে আসে অভিমানের পেয়ালা!
একটু কাশেন পারুল। খুকখুক আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পান সৈকত। সৈকত বলে
-এত কাশছে কেন,? নির্ঘাত ঠান্ডা লাগিয়েছো। বুকে সর্দি বসেছে। যাক কফি বাদ দিয়ে লেবু চায়ের অর্ডার দেই। কাশের উপশম হবে।
মৌন সন্মতি দিয়ে কাশি থামিয়ে পারুল বলে,
-না আমার মতো নেই। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই শুনেছো। আমার স্বামী ওয়াশাতে চাকরি করে। আজিমপুরে সরকারি কোয়ার্টারে আমরা থাকি। আমি কুমুদিনি কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স করে ইডেনে মাস্টার্স করি। তার পরে পারিবারিক আয়োজনে আমাদের বিয়ে হয় একবছর আগে।
-কিন্তু আমি তোমাকে এখনো ভালবাসি।
- আমিও তো তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। সৈকত, একটা সময় আমাদের স্কুলের দিনগুলোতে তুমি ছাড়া আর কারো সঙ্গে কথা বলতে আমার কেন জানি ভালো লাগতো না।
-পারুল, তোমাকে ছাড়াও আমার আর কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগতো না।
- এতই যদি আমাকে ভালবাসতে, তাহলে কেমন করে তুমি আমাকে কোন কিছু না বলেই আমার প্রেম, ভালোবাসা, গান সব নিয়ে হঠাৎপরিবারের সাথে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা চলে এলে? আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে? পরেও তো যোগাযোগ রাখতে পারতে।
ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিতে দিতে সৈকত বলে,
-পরিবারের চাপে হুট করে ঢাকায় চলে আসতে হয়েছে। বিরুপ পরিস্থিতিতে তোমার সঙ্গে সম্পর্কটা এগিয়ে নেয়ার জন্য যে সাহস দরকার, আমার মতো স্কুল পড়ুয়া একজন ছেলের পক্ষে সেটা কতটুকু সম্ভব ছিল, বলো? জীবনে আমাদের প্রত্যেককেই কম-বেশি প্রতিকূল নানা পরিস্থিতির সন্মুখীন হতে হয়। সময়ের চাপে আমরা সেগুলো ভুলেও যাই। কিন্তু কবর খুঁড়ে সেগুলোকে বের করে আনার চেষ্টা করে কী লাভ?
-না হোক, অন্তত যোগাযোগ টা তো রাখতে পারতে।
-তা রাখার চেষ্টা কী কম করেছি? কিন্তু কোন উপায় বের করতে পারিনি। এর মধ্যে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে বাবা কিছুদিন শয্যাশায়ী থেকে অবশেষে মারা গেল। ছোট দু’ভাই বোন সহ পরিবারের জোয়াল আমার কাঁধে চাপল। সেই সময়টা বড় মুশকিলের সময় ছিল। ফলে তখন বুঝে গেছি যা তুমি ভালবাসবে তা তুমি পাবে না। সবকিছু ছেড়ে দিতে হবে। মনে করো, আমাদের কৈশোর প্রেমের নদীর স্রোত বহু পাথরের বাধাবিঘ্ন এড়িয়ে কূলে পৌঁছতে পারেনি। তাছাড়া তখন তো এখনকার মতো মোবাইল, ফেসবুক ছিল না। আমাদের দুজনের ভেতর যে প্রেমের জোয়ার ছিল, তা বাঁধা না পেলে আমরা ঘর বাঁধতে পারতাম।
- যাক আমাদের অতীতের গল্প থাক, বল, এখন তোমার গল্প শুনি।
-আমি মিরপুর বাংলা কলেজ থেকে বাংলায় মাস্টার্স করে একটা পত্রিকায় সাব এডিটর হিসেবে কাজ করছি। পত্রিকায় কলাম লিখি আর কবিতা লিখি, বেশিরভাগই বিরহের কবিতা। বিয়েশাদি এখনো করা হয়নি।
-ও সারাদিন বই খুঁজতে খুঁজতে বউ খোঁজার সময় পাওনি। সবকিছু হারিয়ে এখন নীলক্ষেতের বইয়ের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছো।
ঠিকই বলেছো। ছোটবেলার প্রেম খেয়েছি, বউ খেয়েছি, ফাগুনের আগুনঝরা বসন্ত খেয়েছি। একটু একটু করে বসন্তগুলো উড়ে উবে গেছে একটা নিরুদ্দেশে। একটা নিরুদ্দেশও পালাচ্ছে অন্য এক নিরুদ্দেশে। জীবন থেকে সেই দুরুদুরু অপেক্ষাটা হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তোমার হাতে হাত লেগে যাওয়ার যে শিহরণ, যে উৎকণ্ঠা ছিল সে কি লিখে বোঝানো যায়। যাক, সব চেটেপুটে খেয়ে এখন নীলক্ষেতের ফুটপাথের পুরনো বই ম্যাগাজিনের মধ্যে নিজের আশ্রয় খুঁজে ফিরছি, বলতে পারও কিছুটা আশ্রয় পেয়েছিও। শান্তির আর সুখের আশ্রয়। এখন বইকে ভালোবেসে, বইয়ের সঙ্গে নিজের জীবনকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছি। সৈকত আপন মনে বলে আজ আমাদের সবাইকে নীলকন্ঠ হতে হবে। এই অল্প সময়ে সৈকত দু দু’টো সিগারেট শেষ করল।
সৈকতের কথা শুনে পারুল চোখ বুজে চুপ করে থাকে। কথাগুলো পারুলের নিকট একটু বেশি দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক মনে হয়। সে আর কথা বাড়াতে চাইল না। অন্য দিন আবার দেখা হবে বলে মাসুদকে বিদায় জানিয়ে আজিমপুরের বাসায় যাওয়ার জন্য ভিড় ঠেলে সরু ফুটপাথ বেয়ে হেঁটে গিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়াল রিকশা ধরার জন্য। পিছে পিছে সৈকতও সেখানে এসে দাঁড়াল। সৈকত তাকে কিছু বলতে চায় কিন্তু মুখ ফুটে তা বলতে পারে না। পারুল সেটা লক্ষ করে সৈকতকে বলে,
“তুমি আমাকে ভুলে যাও।“
“না, আমি তোমাকে ভুলতে পারব না। চিরদিন আমি তোমাকে মনে রাখব। তোমার ছবি আমার মনের দেয়ালের ফ্রেমে বেঁধে রাখব।“
পারুল একটা রিকশা পেয়ে দ্রুত তাতে উঠে বসে হুড তুলে দিল এবং রিকশাওয়ালাকে আজিমপুরে সরকারি কোয়ার্টারের দিকে যাওয়ার জন্য হাত দিয়ে ঈশারা করল। সৈকতও ফুটপাথের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলছে দ্রুত পায়ে। দু’একবার ছোট হোঁচটও খেল। কিন্তু পারুলের রিকশার নাগাল পেল না। তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ায় দুজনের মধ্যে ফোন নাম্বারও বিনিময় হল না। সৈকত পারুলের চলে যাওয়া রিকশার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শরতের সকালে আধো আধো অন্ধকারে সে যেমন হেঁটে পার হয়ে যেত স্কুলের মাঠ, সেই একই চঞ্চলতায় সে মাসুদের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে যেন তার কিশোর প্রেমের অন্তর্জলী যাত্রা দেখছে। সৈকতের মুখে ধরানো সিগারেট থেকে বের হয়ে উড়ছে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। যে-কথাটা সৈকত পারুলকে বলতে চেয়েছিল, তা বলে উঠতে পারল না। অথচ কথাটা এখনই বলতে হতো। কথাটা বলা এখন জরুরি এখনই। কেননা এরপর হয়তো অনেকদিন বা কোনদিন আর দেখা হবে না। হয়তো যোগাযোগের সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। সৈকত ভাবে, তবে পারুলও কি তাকে কিছু বলতে চেয়েছিল, যা সে বলে উঠতে পারেনি? কবে যে আর আমাদের দেখা হবে? যাক এসব ভেবে আর লাভ কি। সেতো এখন পরের বউ…
এভাবেই বসন্তে ফোঁটা কত ফুল ঝরে যায় বৈশাখে। পাশে থেকে ভেসে এল এক নিম্ন আয়ের হকারের মৃদু আর্ত চীৎকার... তা যেন তার শুকিয়ে যাওয়া হৃদয়ের গহীন থেকে তীব্রভাবে উঠে আসা ব্যর্থ প্রেমের বেদনার হাহাকারের সাথে মিলে এক অতিপ্রাকৃতিক অদ্ভূত শব্দের মত চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল...